ক্রান্তিকালে পদ্মা সেতু ॥ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রসঙ্গ- ০ ড. মসিউরকে সরে যেতে চাপ ০ পদ্মা সেতুর টাকা খরচের দায়িত্বে ছিলাম না, দুর্নীতিতে জড়াব কিভাবে, পদত্যাগের ব্যাপারে আমাকে কিছু জানানো হয়নি ॥ মসিউর by মিজান চৌধুরী

আবুলের পর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে সরে যেতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সম্ভবত ওই উপদেষ্টাকে সরে যেতে হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে পদত্যাগের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।


তবে ড. মসিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা খরচের দায়িত্বে আমি ছিলাম না। তাহলে দুর্নীতিতে জড়াব কী ভাবে। পদত্যাগের ব্যাপারে সরকার এবং বিশ্বব্যাংক থেকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।
অবশ্য ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের কোন কর্তৃপক্ষই মুখ খোলেননি। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।
সূত্র মতে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার পুনর্বিবেচনা করতে বিশ্বব্যাংক তিনটি শর্ত দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ওই শর্তানুযায়ী নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংক তার ঋণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে যে শর্ত দিয়েছে তার দুটি হচ্ছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুইজনের পদত্যাগ। এর মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ছিলেন। তিনি পদত্যাগ করেছেন। এক মাস পর হলেও আবুল হোসেনের পদত্যাগ সরকার গ্রহণ করেছে।
অপরজন হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। ড. মসিউর রহমান পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি এ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছেন। এ ব্যাপারে নিশ্চিত ক্রান্তিকালে পদ্মা হতে শুক্রবার রাতে জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি মুঠোফোনে জনকণ্ঠকে জানান, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ হচ্ছে সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে। আমি পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা খরচের দায়িত্বে ছিলাম না। তাহলে আমি দুর্নীতিতে জড়াব কী ভাবে।
তিনি আরও বলেন, পদত্যাগ বা সরে যেতে হবে এ ব্যাপারে সরকার বা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাকে কিছু এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি। আমার মনে হচ্ছে কিছু লোক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। তবে পদত্যাগ বা সরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোন খবর আসেনি। সরে যাওয়ার কারণ কী তাও জানি না। একটি ইংরেজী দৈনিক ও একটি নিউজ এজেন্সি আপনার পদত্যাগের সংবাদ প্রকাশ করেছেÑ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি সংবাদের বিষয়টি জানি না।
উল্লেখ্য, ৬ দশমিক ১৫ কি.মি. দীর্ঘ পদ্মা সেতুটি নির্মাণে ২শ’ ৯০ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন অর্থাৎ ১শ’ ২০ কোটি ডলার বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এছাড়া এডিবি ৬১টি কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেয়ায় সম্মত হয়েছিল।
গত ফেব্রুয়ারিতে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণসহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিলেও জুনে এসে এ নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। অভিযোগ ওঠেÑ সেতু নির্মাণের জন্য কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে অবৈধ অর্থ লেনদেনের প্রস্তাব রয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক তার অর্থায়নের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের পর প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা প্রদানের বিষয়ে এডিবি ও জাইকাও রাঙাচোখ দেখায়। এর পর থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকার বিষয়টিতে অস্বস্তিকর সময় কাটাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এ ব্যাপারে সরকারকে যা কিছু করার এ মাসের মধ্যেই করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে অন্য দুই সহ-অর্থায়ন সংস্থা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি তাদের প্রতিশ্রুত ঋণের কার্যকারিতার সময় ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত চলতি সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সমস্যার সমাধানের আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, আশা করি এ সপ্তাহের মধ্যে এর সমাধান হবে।
এদিকে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টিতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই চূড়ান্ত। এখন তা বাস্তবায়নের অপেক্ষা মাত্র। প্রথম শর্ত আবুল হোসেনের মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়া, সেটি সরকার যথাযথভাবে সম্পন্ন করে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করেছে। দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সরে যাওয়া অথবা তাকে ছুটিতে পাঠানো। আর তৃতীয় শর্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলের প্রবেশাধিকার রেখে টার্মস অব রেফারেন্স চূড়ান্ত করা।
এসব শর্ত মেনেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে বলে সূত্র জানায়। এ নিয়ে নতুন একটি চিঠি অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকে পাঠাবেন যা এখন খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। চিঠিটিও নতুন সপ্তাহেই পাঠানো হবে। তবে তার আগে বিশ্বব্যাংকের সব শর্তই মেনে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছে সরকার। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিগন্যাল পেলে দুদকও এ বিষয়ে টার্মস অব রেফারেন্স সই করবে বলে জানিয়েছে সূত্র।
এর আগে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণেরও ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মালয়েশিয়া থেকে অর্থ নিয়ে সেতু করা হবেÑ সে ব্যাপারেও চলে তোড়জোড়। তবে অর্থমন্ত্রী গোড়া থেকেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি সমঝোতার একটি স্থানে নিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের প্রথমে ওই পদ ছেড়ে দেয়া এবং পরে মন্ত্রিসভা থেকেই সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.