শিক্ষার্থীর পকেটে দলীয় পরিচয়পত্রঃ টোটকা চিকিত্সায় অসুখ সারবে?

শিক্ষাঙ্গনের অশান্ত অবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ক্রমাগত জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ভর্তি বাণিজ্য, আবাসিক হলের সিট দখল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ শিক্ষাঙ্গনে দলীয় লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা পেশিশক্তির ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে।

প্রতিনিয়ত পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মারপিট ও ভাংচুরের সংবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডেও যেমন খুশি নগ্ন হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। তাদের মর্জি পূরণে কোনো বাধা দেখা দিলেই তা রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছে এবং বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশিরভাগই ক্ষমতাসীনদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে প্রতিকার পাওয়ার আর কোনো আশাই থাকছে না। এ অবস্থার নিরুপায় শিকার হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের তথা ভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মতবিরোধ দেখা দিলেই ছাত্রলীগ সদস্যদের হাতে প্রহৃত হচ্ছেন তারা। এতে স্বভাবতই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে, এমনকি হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।
শিক্ষাঙ্গনের এই ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে, এখন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র আর কোনো কাজে লাগছে না। কারণ ছাত্র বড় কথা নয়, কোন ছাত্র সংগঠনে বা কোন দলের সমর্থক সেটাই বিবেচ্য বিষয়। কাজেই নির্যাতন ও হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেক ছাত্রই এখন বহন করছে আওয়ামী লীগের ‘পরিচয়পত্র’। ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নাগরিক পরিচয়পত্রের আদলে দলীয় ‘প্রত্যয়নপত্র’ দিচ্ছেন। সেগুলো শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তার উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা। এ থেকে সহজেই আঁচ করা যায়, ছাত্রলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ হয়রানির বিষয়টি যেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছেন।
জানা গেছে, ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন কলেজ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘দলীয় পরিচয়পত্র’ ব্যবহৃত হচ্ছে। ১০ মার্চ দৈনিক আমার দেশ-এ ‘শিক্ষার্থীরা এখন পকেটে রাখে আ’লীগ নেতার সার্টিফিকেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সঙ্গে এ ধরনের একটি পরিচয়পত্রের ফটোকপিও প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধরপাকড়-হয়রানি শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান চালায় পুলিশ ও র্যাব। এতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে ছাত্রলীগ। সন্দেহ হলেই মারধর, তারপর পুলিশে সোপর্দ। অভিযোগ আছে, এ পরিস্থিতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও বিপাকে পড়েছে। বেশি বেকায়দায় পড়েছে আবাসিক হলের নামাজি এবং ক্যাম্পাসে বোরখাধারী ছাত্রীরা। এ অবস্থায় ‘দলীয় পরিচয়পত্র’ যে ভালো কাজ দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এ ধরনের সার্টিফিকেট যদি নিরাপত্তার রক্ষাকবজ হয়, তা যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্যই দুঃসংবাদ। এটা শুধু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই প্রমাণ করে না, বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ যে কণ্টকাকীর্ণ, সে কথাও প্রমাণ করে। শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা ভূলুণ্ঠিত করবে সন্ত্রাস-আশ্রিত কোনো ছাত্র সংগঠন আর তাতে সায় দেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা—এ ধরনের অভিযোগ যে কোনো সভ্য মানুষের জন্যই বিব্রতকর। এর ওপর যদি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা সেই উত্তপ্ত চুলায় ‘দলীয় পরিচয়পত্রে’র মতো ইন্ধনের যোগান দেয়, তাহলে চরম হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। না, এসব টোটকা চিকিত্সায় অসুখ সারবে না বরং বাড়বে। আমরা ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনের নেতাকর্মীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতমূলক অবস্থানের নিন্দা জানাই। সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশা করি এবং ‘দলীয় পরিচয়পত্র’ বহন করার মতো অসহায়ত্ব থেকে শিক্ষার্থীদের পরিত্রাণ দাবি করি।

No comments

Powered by Blogger.