আজকের ভাবনা ॥ দাবার ঘুঁটি কারা চালে! by এম এ রশীদ

বাংলার মানুষের স্মৃতিতে এখনও ভাস্বর বাংলা ভাইয়ের সুকৃতির রগরগা কাহিনী। নাটোরের অদূরে বাগমারা অঞ্চলে আফগান যুদ্ধফেরত এই তালেবান ভাইটি তাদের নিজস্ব মডেলের ইসলামী শাসন বাংলাদেশে কায়েমের জন্য একটি সন্ত্রাসের এলাকা গড়ে তোলে।


সেখানে দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে বিরোধীদের পিটিয়ে হত্যা করে জনাজাবিহীন অবস্থায় মরদেহ উল্টো করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। তার (সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই) নির্যাতনের নিষ্ঠুর কাহিনী শুনে এলাকার লোকজন খুবই আতঙ্ক বোধ করছিল। মিডিয়ায় তার সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হলে তার পৃষ্ঠপোষক জামায়াতী মন্ত্রীরা বলত এগুলো মিডিয়ার কাল্পনিক সৃষ্টি। মিডিয়ায় তার বাহিনীর কুকীর্তির বিবরণ বার বার প্রকাশ হতে থাকলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে তার গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। বিস্ময়ের বিষয়, তার নির্দেশের পরও পুলিশ বাংলা ভাইকে খুঁজে পায় না। এরই মধ্যে আবার পুলিশের নিরাপত্তায় তার সমর্থকরা রাজশাহীতে সাড়ম্বরে মিছিল করে। এত কিছুর পরও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলা ভাইকে স্পর্শ করা যায়নি। অবশেষে ফখরুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকার তাকে গ্রেফতার ও বিচার করে এবং তার ফাঁসির দ- কার্যকর করে।
এর পর পরই বাংলার ভূমিতে জেএমবি নামক সন্ত্রাসী একটি সংগঠন গজিয়ে উঠল। মূলত বাংলার উত্তর ও মধ্য ভূখ-ে। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ এদের প্রভাব বলয়ের বাইরেই রয়ে গেল। তাদের গঠিত সুইসাইড স্কোয়াড বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিচারকার্য পরিচালনারত দু’জন সহকারী জেলা জজকে ঝালকাঠির আদালত ভবনে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ লোমহর্ষক ঘটনা সত্ত্বেও তৎকালীন জোট সরকারের মোহ ভঙ্গ হয়নি। অবশেষে ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাদের বিচার হয় ও ফাঁসির দ- কার্যকর হয়।
আরেক গ্রুপ প্রকাশ্য প্রচারণা চালায় দেশে খেলাফতী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুকূলে। তারা আবার গিরগিটির মতো রং বদলায়। কখনও প্রচারপত্র বিলি করে হিযবুত তাহরীরের নামে, কখনও করে হিযবুত তাওহীদের নামে। উভয়ের বক্তব্যের মূল সুর কিন্তু অভিন্ন। এ দেশ মুসলমানদের দেশ। তাই এ দেশে পশ্চিমা ছাঁচের গণতন্ত্র অচল। এ দেশে চলবে খেলাফতী হুকুমত।
এসব আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বহুমাত্রিক। একে তো তারা পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন নামে-বেনামে ধর্মীয় প্রচারণা চালিয়ে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-কে আড়াল করে এই ছোট্ট সুন্দর শান্তির বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত করতে চায়। তা করতে সাফল্য লাভ করলে, যে লক্ষ্য ও পূর্ণ আদর্শ নিয়ে লাখ লাখ বাঙালী ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের ত্যাগ ও আদর্শকে ব্যর্থ ও বিফল করে দেয়া সম্ভব হবে। আরেকটি বড় দিক হলোÑপার্শ্ববর্তী বড় দেশ ভারত যেহেতু হিন্দুপ্রধান, তাই তাদের বিরুদ্ধে সত্য ও অসত্য প্রচারণা চালিয়ে সহজেই এই জাতির মনে ঐ দেশবিদ্বেষী জিগির প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।
আবার আমাদেরকে জেএমবি, জেএমজেবি, হিযবুত তাহরীর, হিযবুত তাওহীদ ও খেলাফতপন্থী হবার জন্য পবিত্র ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিয়ে এই পতাকা, এই স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিতে উস্কানি দিচ্ছে। পাকিস্তান নামক সীমিত আকারের এক তথাকথিত ধর্মীয় রাষ্ট্রের নির্যাতন ও নিষ্পেষণ থেকে বিপুল শোণিত বিসর্জন দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীন আবাসভূমি বিসর্জন দেব আমরা কিসের আশায়-কিসের নেশায়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি আমাদের শোষণ ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে আমাদের সেই আশা ও সেই নেশার ঘোর থেকে মুক্তি দিয়েছে।
কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে কার কোন দাবার ঘুঁটি কে চালছে বোঝা মুশকিল। সাম্প্রতিক ইতিহাস তো সবারই জানাÑনেই কোন দ্বিরুক্তির প্রয়োজন। এখন তো এ দেশে কোন বোমাবাজি নেই, নেই কোন গ্রেনেড হামলা। বিরোধী নেত্রীর নিরাপত্তার কোন ব্যত্যয় ঘটে না। বিচারকার্যরত বিচারকদের ওপর হামলা তো দূরের কথাÑকোন রকম বোমাবাজিই আর ঘটছে না। তাহলে এই অবস্থা বিসর্জন দিয়ে বাংলার জনগণ সেই অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, বোমাবাজ ও গ্রেনেডবাজদের আমলে ফিরে যেতে চাইবে? মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক প্রচারণাকে যদি স্বাধীন মিডিয়া বলা হয়, তবে তার চেয়ে দেশবাসী অধিক হারে কামনা করে নিরপেক্ষ প্রচারণাÑযা বিগত শাসনামলে ও বর্তমান শাসনামলের একটি তুলনামূলক চিত্র জনগণকে উপহার দেবে।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে সরকার সাফল্য দাবি করতে পারছে না। স্টক মার্কেটে সরকারের বড় আকারের ব্যর্থতাÑএটা সহসা সামাল দেয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। বিদ্যুত খাতে লোডশেডিং ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছেÑতাও আবার বিদ্যুতের মাসুল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে আবার দায়িত্বশীল ব্যক্তি দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসবের তুলনায় সরকারের সামগ্রিক সাফল্যের পাল্লা অনেক ভারি। সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করব না। কিন্তু এটুকু বলব মিডিয়ার স্বাধীন একতরফা প্রচারণার কোন সার্থক জবাব সরকার পক্ষ থেকে দেয়া হয় না। ফলে প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকার নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে। এরই মধ্যে বিরোধী পক্ষ দেশে ও বিদেশে বিপুল অর্থ ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে সরকারের বিরুদ্ধে অহরহ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ড. ইউনুচের গ্রামীণ ব্যাংক হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা। তার নিজস্ব প্রভাব ও লবি, যুদ্ধাপরাধীর লবি ও সরকারবিরোধী লবির একীভূত প্রভাবে বিশ্বব্যাংক স্বচ্ছতার অভাবের প্রশ্ন তুলে আমাদের প্রেস্টিজ প্রকল্প পদ্মা সেতুর আশু বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার দোলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন, এসব কিছুর সম্মিলিত প্রতিফলন হিসেবে আগামীতে হয়তো সেই পরিত্যাজ্য বোমাবাজ, গ্রেনেডবাজ, জেএমবি ও খেলাফতী বিচারক হন্তারক শক্তি ক্ষমতায় ফিরে আসবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সে পরিস্থিতি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তির কাম্য হতে পারে না। আগেই এক জায়গায় বলেছি, কার দাবার ঘুঁটি কে চালে বলা যায় না। আমাদের দেশটি আকারে ছোট একটি দরিদ্র দেশ এবং ইসলামী মূল্যবোধে খুবই দৃঢ়। সাম্প্রতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আফগানিস্তানে কারা অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ ও কূটনীতির মাধ্যমে তালেবান সৃষ্টি করেছে। যারা সৃষ্টি করেছিল তারাই আবার সন্ত্রাসী কর্মকা- নির্মূল করার অজুহাতে সেই আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানকে কি ভেল্কিবাজি খেলা দেখাচ্ছে। পশ্চিমা শক্তি বাংলা সরকারের প্রতি আরও ক্ষুণœ ইউনুস লবির কারণে। সব কিছু মিলিয়ে যদি এই দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- উৎসাহিত করে তালেবানী অজুহাতে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তাহলে সেই সুযোগ তারা হাতাছাড়া করবে বলে মনে হয় না।

লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব

No comments

Powered by Blogger.