যুক্তরাষ্ট্রে কাশেম আলীর ভাই লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে লবিংয়ে- যুদ্ধাপরাধী বিচার বন্ধে তৎপরতা

যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম যত না দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি গতিতে এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক লবিং বিশেষ করে আমেরিকায় লবিং চলছে। আর এই তৎপরতায় লাখ লাখ ডলার ব্যয়ের কাহিনীও বেরিয়ে আসছে। জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী গ্রেফতার হওয়ার আগে থেকেই এ বিষয়টি তদারকি করে আসছিলেন।


সে সময় ঘন ঘন আমেরিকা সফর করে ইউএস সিনেট ও কংগ্রেসের মাধ্যমে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করতে মীর কাশেম আলীর লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগের সেই মিশনে তাঁর সঙ্গী ছিলেন জামায়াতের আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রাজ্জাক। এদিকে মীর কাশেম আলী গ্রেফতার হবার পর সিনেট-কংগ্রেসে (৬ পৃষ্ঠা ৪ কঃ দেখুন) যুক্তরাষ্ট্রে কাশেম ব্যয়বহুল লবিং বন্ধ নেই জামায়াতীদের। জামায়াতের ছায়া সংগঠন ‘মুসলিম উম্মাহ’র অনেক নেতাই এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে লবিং তৎপরতায় সরাসরি যোগ দিয়েছেন।
গ্রেফতার হবার আগে মীর কাশেম আলী আমেরিকার অন্যতম সেরা ও ২০১০ সালের শীর্ষ তালিকার ছয় নম্বরের লবিস্ট ফার্ম ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে ২০১১ সালে নিয়োগ দিয়ে তিন কিস্তিতে পর্যায়ক্রমে দুই লাখ ৮০ হাজার ডলার পরিশোধ করেন। এ খবর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বের হবার পর জামায়াতীরা কৌশল পাল্টে ফেলে। এখন আর কোন বাংলাদেশী নয়, আমেরিকান নাগরিককে দিয়ে তারা লবিস্ট ফার্ম ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে অর্থ পরিশোধ করছে। আর এই কাজটি করছেন মীর কাশেম আলীর সহোদর ও মুসলিম উম্মাহর কর্মকর্তা মীর মাসুম আলী। মীর মাসুম আলী গত সাত মাসেই দুই লাখ ৭০ হাজার ডলার দিয়েছেন লবিস্ট ফার্ম ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে। এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে মীর মাসুম আলী আরও ৮০ লাখ ডলার দেন প্রতিষ্ঠানটিকে। সব মিলিয়ে কাশেম আলী ও তাঁর ভাই মাসুম আলী বাংলাদেশী টাকায় সোয়া ৫ কোটি টাকা দিয়েছেন লবিস্ট ফার্ম ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে। মীর কাশেম আলীর মতো মীর মাসুম আলীর দেয়া অর্থের হিসাব সিনেটের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে সিনেটে লবিংয়ে দেয়া অর্থ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার কোন প্রয়াসে না তার বড় ভাই মীর কাশেম আলীর স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ‘দিগন্ত টিভি’কে সম্প্রচারের অনুমোদনের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে বলে কোথাও কোথাও মীর মাসুম আলী যে মন্তব্য করেছেন তাকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন নিউইয়র্কের বিভিন্ন বাংলাদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত উর্ধতন কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের কথা, আমেরিকায় টিভি চ্যানেল আনতে সিনেট বা কংগ্রেস নয়, এখানকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় এবং সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় সরাসরি এবং এর জন্য তাদের কেউ কখনও কোন লবিস্ট ফার্মকে দিয়ে সিনেটে লবিং করেননি।
এদিকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টার পাশাপাশি দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যও জামায়াতের আমেরিকান অনুসারীরা কাজ করছেন বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশ বিষয়ক শুনানিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যত না আলোচনা হয় তার চেয়ে বেশি হয়েছে কেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়নি বিষয়টি নিয়ে। আর খবরটি নিউইয়র্কসহ আমেরিকার প্রবাসীদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। একটি সূত্র বলেছে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের শুনানিতে অংশ গ্রহণকারী আইন প্রণেতাদের কারও কারও নির্বাচনী ফান্ডে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিয়েছে এখানকার জামায়াত সমর্থকরা যাতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচিত হয় এবং বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয় তাদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিতে।
ব্যয়বহুল লবিংয়ের লাখ লাখ ডলার কি দেশ থেকে পাচার হয়ে আাসছে নাকি স্থানীয়ভাবে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। অনেকে বলছেন, নিউইয়র্কসহ আমেরিকার বাংলাদেশী মসজিদগুলোর পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে জামায়াতীরা এসব মসজিদে দেয়া মুসল্লিদের দানের অর্থ তাদের লবিংয়েং ব্যয় করছে। আবার অনেক জামায়াতপন্থী পেশাজীবীও তাদের নেতাদের রক্ষায় বিশাল অঙ্কের ডোনেশন দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সিনেট-কংগ্রেসে লবিংয়ের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলন উপলক্ষে নিউইয়র্ক সফরের সময়ে ব্যাপক শোডাউন করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে জামায়াতীরা। এ ক্ষেত্রে নেপথ্যে থেকে মুসলিম উম্মার কর্মকর্তারা দিনরাত কাজ কের যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে জড়িত দুয়েকজন। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তার সংবর্ধনা চলাকালীন ম্যানহাটানে যে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ করে তার ভিডিও ফুটেজগুলো আমেরিকার প্রশাসন ও আইন প্রণেতাদের দেখিয়ে জামায়াতীরা বোঝাতে চেয়েছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের বিষয়টি সমর্থন করে না। এবার আরও বড় ও একাধিক সমাবেশ করে তাদের অপপ্রচারকে আরও বিস্তৃত করার প্রয়াস নিচ্ছে জামায়াতপন্থীরা।
এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে জামায়াতীদের সংঘবদ্ধ প্রয়াসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির তৎপরতার তেমন চোখে পড়ে না এখানে। সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা বছর সোচ্চার রয়েছে এখানকার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। আর আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে বিষয়টি মৌসুমী প্রতিবাদের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই দেখা যায় মার্চ ও ডিসেম্বর মাসেই শুধু তারা এ নিয়ে হৈচৈ ও যা কিছু কর্মসূচী পালন করেন। অবশ্য যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিকে সোচ্চার করে তোলা এবং এখানকার আইন প্রণেতাদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে সমর্থন আদায় করার বিষয়টি ব্যয়বহুলই বলা যায়। সভা সমাবেশ করতে ও ব্যানার পোস্টার বানাতে যত না অর্থের প্রয়োজন হয় তার চেয়ে ঢের বেশি অর্থের প্রয়োজন এ বিষয়ে সমর্থন নিতে যাওয়া সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের ফান্ড রেইজিংয়ে অংশ নিতে। এটা না করলে এখানকার সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সমর্থন তো দূরের কথা তাদের মুখ দিয়ে একটি কথাও বের করা যায় না। আর তাই শুধু ফান্ডের অভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে প্রবল প্রচার করতে পারছেন না এখানকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রবাসীরা।

No comments

Powered by Blogger.