সংসদঃ শিষ্টাচার দুর্নীতি ও জনস্বার্থ by মাহবুব তালুকদার

গুরুদেব তাহার যোগাসনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রহিয়াছেন। শিষ্য একদৃষ্টে তাহার প্রতি অবলোকন করিতেছিল। ধ্যানে নিমগ্ন থাকিলে গুরুদেবের মুখমণ্ডল আলোকিত হইয়া ওঠে। কেন এইরূপ হয়, উহা এক পরম রহস্য। শিষ্য ধারণা করিল, প্রভু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ সম্পর্কে সর্বজ্ঞ। তথাপি তিনি অতি সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করেন, যাহাতে বিস্মিত হইতে হয়।
কোনো কোনো বিষয়ে তিনি এমন বক্তব্য রাখেন যে মনে হয় তিনি শিষ্যের ন্যায় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করিতেছেন। ইহা কি কোনো খেলা না লীলাখেলা, শিষ্য ভাবিল।
এক সময়ে গুরুদেবের ধ্যানভঙ্গ হইল। তিনি শিষ্যের প্রতি সদয় নেত্রপাত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
যথা আজ্ঞা প্রভু! শিষ্য প্রত্যুত্তর দিল।
বাঙালি যে লড়াকু জাতি উহার প্রমাণ কী? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন।
প্রভু! হাজার বত্সরের বাঙালির ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করিলে প্রতীয়মান হয় বাঙালি জাতি যুগে যুগে লড়াই করিতে করিতে এই পর্যন্ত আসিয়াছে।
অতি সাম্প্রতিককালে উহার কোনো নজির আছে কি?
মহাত্মন! আপনি কি জাতীয় সংসদের যুদ্ধাবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করিতেছেন?
সাধু! তোমার অনুমান সঠিক হইয়াছে। তবে মাননীয় স্পিকার সংসদের অভ্যন্তরে সংসদ সদস্যদের ফাইটিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান লইয়াছেন।
উহার কারণ কি প্রভু? আমরা যে একটি বীরের জাতি, তাহা কি উনি বিস্মৃত হইয়াছেন?
তুমি তাহাকে কিঞ্চিত্ ভুল বুঝিয়াছ। গুরুদেব কহিলেন, স্পিকার মহোদয় কাহাকেও যুদ্ধ করিতে বারণ করেন নাই। বরং তিনি সংসদ সদস্যগণকে গায়ে তেল মাখিয়া অন্তর্বাস পরিয়া সংসদের সম্মুখে উন্মুক্ত স্থানে অথবা পল্টন ময়দানে গিয়া যুদ্ধ করিতে পরামর্শ দিয়াছেন। ইহার অধিক বেদনাদায়ক কথা আর কিছুই হইতে পারে না।
গুরুদেব কেন ঘটনাটিকে বেদনাদায়ক বলিয়াছেন, শিষ্য উহা সম্যক অনুধাবন করিল। এই ঘটনার কয়েকদিন পূর্ব হইতেই জাতীয় সংসদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের পারস্পরিক কটূক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাইয়া ছিল। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানের লাশ লইয়াও মাত্রাহীন কটাক্ষ ও কটূক্তির এক পর্যায়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে মারমুখী হইয়া উঠে এবং একে অপরের প্রতি তাড়িয়া যায়। স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ওই সময়ে সংসদে ছিলেন না। ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী সংসদে সভাপতিত্ব করিতে ছিলেন। যাহা হউক, আল্লাহর অপরিসীম রহমতে আরও বড় ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হইতে সংসদ রক্ষা পায়।
পরদিন মাননীয় স্পিকার ক্ষুব্ধ-ব্যথিত কণ্ঠে কঠোর ভাষায় উল্লিখিত ঘটনার নিন্দা জানান। তিনি সংসদের মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখিবার কথা স্মরণ করাইয়া ওইরূপ ঘটনা জাতির জন্য দুঃখজনক ও লজ্জাকর বলিয়া উল্লেখ করেন। কেহ শালীনতার সীমা অতিক্রম করিলে তাহার মাইক বন্ধ করা হইবে বলিয়াও তিনি জানান। এতদ্ব্যতীত মাননীয় স্পিকার তাহার রুলিং ও নির্দেশ অমান্য করিলে স্বীয় আসন পরিত্যাগ বা পদত্যাগেরও হুমকি দেন। ইহাতে অবশ্য কাজ হয়। সংসদে উভয়পক্ষের সদস্যগণের শালীনতার বোধ ফিরিয়া আসিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে। আরও কিছুদিন অতিবাহিত হইলে সংসদ সদস্যদের কোনো শুভ পরিবর্তন হইয়াছে কিনা, তাহা বোঝা যাইবে।
শিষ্যকে দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ দেখিয়া গুরুদেব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি ভাবিতেছ?
জাতীয় সংসদের কথাই ভাবিতেছি। পাশাপাশি ভারতীয় পার্লামেন্টের একটি সংবাদ মনে পড়িতেছে।
ভারতীয় পার্লামেন্টের সংবাদ!
হ্যাঁ, স্যার! কয়েকদিন পূর্বে সংবাদটি আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে।
কি সেই সংবাদ?
শিষ্য বলিল, সম্প্রতি ভারতীয় লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির মধ্যে এক বিরল তর্কযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার দ্বৈরথ সকল ভারতবাসীর নিকট খুবই উপভোগ্য ছিল। আদভানি অভিযোগ করিয়াছিলেন, আমেরিকার চাপে মনমোহন সিং পাকিস্তানের সহিত আলোচনা আরম্ভ করিয়াছেন। এইটুকু বলিতেই প্রধানমন্ত্রী সকলকে অবাক করিয়া বক্তব্য রাখিতে দাঁড়াইয়া পড়েন। আদভানিও কথার মাঝখানে থামিয়া গিয়া মনমোহন সিংকে বক্তব্য রাখার সুযোগ করিয়া দেন। প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে বলেন, আপনি এইরূপ নতুন থিউরি আবিষ্কার করিলে জনগণকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আপনাকেই পালন করিতে হইবে। এই কথায় লোকসভায় হাসির রোল পড়িয়া যায়।
শিষ্যের কথা শুনিয়া গুরুদেব কহিলেন, বাছা! এহেন উদাহরণ দিয়া কি কোনো লাভ আছে? আমরা কোনো রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারি না, সংসদের ভেতরে তো নয়ই। আমাদের দুই নেত্রী ২০ সেকেন্ড শুভেচ্ছা বিনিময় করিলে মিডিয়া আনন্দে ফাটিয়া পড়ে। ইহা যে কত বড় রাজনৈতিক দৈন্য তাহা বলিয়া আর দুঃখ বাড়াইতে চাহি না। গুরুদেব আরও বলিলেন, দীর্ঘদিন বিরোধী দল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগদান করা হইতে বিরত ছিল। এক্ষণে বিরোধী দলের উপস্থিতিতে সংসদের কার্যকারিতা কতখানি বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহা দেখিবার অপেক্ষায় আছি।
প্রভু! একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জাতীয় সংসদের কার্যক্রমে আমি হতাশ।
তোমার হতাশার কারণ কি?
এই সংসদ যখন যাত্রা শুরু করিয়াছিল তখন সরকারি দল ও বিরোধী দলের একত্র উপস্থিতিতে খুবই আশান্বিত হইয়াছিলাম। পরে দেখা গেল, বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত। অন্যদিকে সংসদের অতীতের ঘটনা ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া সরকারি দল কেবল দুর্নীতি উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত রহিয়াছে।
বত্স! দুর্নীতির বিষয় অতীব মুখরোচক এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য উহা ব্রহ্মাস্ত্র বলা যাইতে পারে।
স্যার! সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম দেখিয়া মনে হইতেছিল উহারা দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান সহযোগী। প্রাক্তন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও চিফ হুইপের দুর্নীতির খতিয়ান তৈয়ারি করাই উহার প্রধান কাজ। জরুরি ক্ষমতাবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি লইয়া যে বাড়াবাড়ি আরম্ভ হইয়াছিল, তাহার রেশ যেন তখনও কাটে নাই।
গুরুদেব বলিলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতিবিরোধী সরকার বলিয়া নিজেদের জাহির করিতে চাহিলে তোমার আপত্তি কেন?
প্রভু! আমার কোনো আপত্তি নাই। যে কোনো দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিও নিজেকে দুর্নীতিবিরোধী ভাবিতে ভালোবাসে। তবে এই কথা বলিয়া আমি কাহারও সম্পর্কে কটাক্ষ করিতে চাহি না।
কিন্তু এইরূপ নেতিবাচক কথা তোমার মনে হইতেছে কেন?
হুজুর! মনের মুক্ত ভাব প্রকাশ করিতে আমি অনেক সময় দ্বিধান্বিত হইয়া পড়ি।
তুমি নির্ভয়ে বলিতে পারো।
কয়েকদিন পূর্বে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান ও যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করিয়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ও গোলাম মওলা রনি প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়াছিলেন।
হ্যাঁ। সংবাদটি আমিও পাঠ করিয়াছি।
ইহার ফলশ্রুতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উক্ত দুই সদস্যের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন এবং আর বাড়াবাড়ি করিলে ওমর ফারুক চৌধুরীকে দল হইতে বহিষ্কার করা হইবে বলিয়া জানাইয়া দিয়াছেন।
ইহা কি সত্য?
একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছে, যাহার শিরোনাম : ‘মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলায় নিজ দলের দু্ই এমপির ওপর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী’। (আমাদের সময়, ৫ মার্চ, ২০১০)।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে এইরূপ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিতেই পারেন।
মহাত্মন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া লইয়া আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। তবে আমি খুশি হইতাম যদি দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টিও তিনি অনুরূপ গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করিতেন।
প্রধানমন্ত্রী হয়তো গোপনে তাহা করিয়াছেন।
তিনি কি করিয়াছেন, আমরা জানিতে না পারিলে কল্পনা করিয়া লাভ কি?
সাধু! এক্ষণে বলো, জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
প্রভু! জনস্বার্থের বিষয়ে সংসদ কোনোরূপ কার্যকর ভূমিকা রাখিতে পারিতেছে না।
কিন্তু সংসদে তো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হইতেছে।
আমি তাহা অস্বীকার করিতেছি না। শিষ্য জানাইল সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রবমূল্য বৃদ্ধি, বিশেষভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি লইয়া সংসদে কোনো আলোচনা দেখা গেল না।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তা পর্যায়েও তেমন কোনো প্রতিবাদ নজরে পড়ে নাই। গুরুদেব জানাইলেন।
শিষ্য বলিল, ভোক্তাদের সংগঠন ‘ক্যাব’ তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখিতে পারিতেছে না। তবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাইয়াছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এমনকি ডক্টর কামাল হোসেনের দল গণফোরাম। কিন্তু বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি লইয়া সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল নাকি?
বত্স! সংসদে সর্বাগ্রে শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠিত হউক। গুরুদেব শান্তকণ্ঠে কহিলেন, উহার অধিক এক্ষণে আর আশা করিয়া লাভ নাই।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল: mahbub_talukdar@yahoo.com
সম্পাদকীয়

No comments

Powered by Blogger.