শহীদ জিয়ার রাজনীতির গুরুত্ব ও তাত্পর্য by প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুব উল্লাহ্

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের বাস্তবায়নের গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও নেতৃত্বের বলয়ে আমরা যদি ইতিহাসের দিক থেকে তাকাই তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই।
তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে, জাতি গঠনে, রাজনৈতিক চেতনা নির্মাণে, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এ কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দ্বারা তাদের অবদান যথার্থ নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জাতির সামনে তুলে ধরা আবশ্যক। কেননা বাংলাদেশ আজ থেকে ৩৯ বছর আগে একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ প্রাণের এবং অনেক মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই ৩৯ বছরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক বাস্তবায়ন যে প্রক্রিয়ায়, যে আদলে, যে চেতনায় এবং যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে কার্যকর হওয়ার প্রয়োজন ছিল, রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই লক্ষ্যে দেশকে উন্নীত করার রাজনীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। অতীব দুঃখজনক যে, আমরা এই ৩৯ বছরে আমাদের ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের অবদানকে যথার্থভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে জাতির সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হইনি। আমরা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক নেতার অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দলীয়ভাবে বড় করতে গিয়ে তাঁদেরকে ছোট করা হয়েছে, ক্ষুদ্র করা হয়েছে, অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং জাতি এ কারণে একটা বিভ্রান্তিমূলক অবস্থানে পতিত হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি, আজকে এই মুহূর্তে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যিনি প্রেসিডেন্ট জিয়া হিসেবে দেশবাসীর কাছে অধিক পরিচিত, তাঁর কর্মের ও অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে, ব্রিটিশ আমল থেকে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাতন্ত্র্যবোধের চিন্তাকে ধারণ করে পর্যায়ক্রমে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৪৮, ১৯৫২ এবং এরও আগে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব যে, আজকের যে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে এবং এই ধারাবাহিকতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যাদের অবদান সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে জাতি মনে করে, তাদের মধ্যে রয়েছেন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এদের প্রত্যেকের অবদানের কারণেই জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে আসীন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই, আমরা বিগত ৩৯ বছরে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান—এই দুই ব্যক্তিত্বকে আমাদের জাতি বিভক্তির অনুসরণে দলীয়ভাবে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁদের যে প্রকৃত অবদান, অবদানের যে মাত্রা এবং অবদানের যে মহত্ব ছিল, সেগুলোকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হইনি। তাঁদের বিতর্কিত করেছি, খাটো করেছি।
শহীদ জিয়া এক বিশেষ পরিস্থিতিতে কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাই দেননি, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। মেজর জিয়ার ঘোষণাকে যারা অস্বীকার করতে চান, বিতর্কিত করেন, তাদের প্রতি আমার করুণা হয়, কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে তারা যত বাগাড়ম্বরই করুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকৃতার্থে তাদের যে কোনো শ্রদ্ধাবোধই নেই, তাদের আচরণে এটাই প্রমাণিত হয়। শহীদ জিয়াউর রহমান এদেশের রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দর্শনে, জাতি বিনির্মাণে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, জাতির স্বাতন্ত্র্য নির্মাণে গুরত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। দেশের ভেতরে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন সূচনা করে গেছেন। অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, জাতীয়তাবাদী দল গঠন করাই ছিল শহীদ জিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান। আমি বলব যে, এটি একটি বড় অবদান নিঃসন্দেহে, কিন্তু শহীদ জিয়ার সবচাইতে বড় অবদান হচ্ছে এই যে, তিনি একটি জাতীয়তাবাদী দর্শন জাতিকে উপহার দিয়েছেন এবং সেটি হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বস্তুত কোনো দলের জাতীয়তাবাদ নয়, এটি সমগ্র জাতির সমন্বিত পরিচয়ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
এ কথা ঠিক যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আওয়ামী লীগের যে ২১ দফা, ৬ দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফা ছিল, সেগুলোর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল। এবং সমগ্র জাতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছিল এবং জাতির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জাতিবিদ্বেষী এবং আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্তের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতি সে সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোয় যথার্থ রাজনৈতিক প্রতিবাদের রাজনৈতিক ঐক্যচেতনা খুঁজে পায় এই বাঙালি চেতনার মধ্যে, কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি ছিল না। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলেও স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পর, পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গড়ে ওঠা বাঙালি চেতনা এখন আর আমাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে উেক্ষপণ বা তুলে ধরতে প্রায়োগিকভাবে সক্ষম হচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে অনেক বাস্তব কারণ।
জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলাদা একটি পলিটিক্যাল ভায়াবিলিটি বা রাজনেতিক যৌক্তিকতা ছিল, যা আর এখন কার্যকর করা যাচ্ছে না। পশ্চিমবাংলার মানুষের ভাষা বাংলা এবং বাংলাদেশের মানুষের ভাষাও বাংলা। সুতরাং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে প্রণোদনা, প্রায়োগিকতা ও যৌক্তিকতা, সেটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কার্যকর থাকত যদি আমাদের বাস্তব অবস্থাটা এরকম হতো যে, বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর বিশ্বের আর কোনো দেশে বাংলা ভাষায় আর কেউ কথা বলে না, বাংলা ভাষা ও বাঙালি আর কোথাও নেই। সে রকম একটি পরিস্থিতি যদি হতো তাহলে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি রাজনৈতিক যৌক্তিকতা থাকত। আবার পাশাপাশি এটিও দেখতে হবে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাষা বাংলা হলেও সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাসমূহের ভাষা বাংলা নয়; সুতরাং বাংলা বা বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আমাদের এদেশের অন্তর্ভুক্ত সব ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে যেমন ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না, তেমনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যদি আমাদের জাতীয়তাবাদ হিসেবে কার্যকর করি তাহলে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে আমাদের যে রাষ্ট্রীয় পার্থক্য আছে, সেটি স্পষ্টতর হয় না। তাই অনুধাবনে নিতে হবে যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক, আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ভূগোল-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রভিত্তিক।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবাংলা, ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলেও, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে একটি স্বাধীন আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক মাত্রা এ চেতনার মধ্যে প্রণোদিত আছে। সুতরাং ১৯৭১ সালে যে লাখ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, নিশ্চয়ই তারা চাননি যে, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অর্জিত হওয়ার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বৃহত্তর প্রণোদনার মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলা তথা আজকের জাতিরাষ্ট্র এবং পশ্চিমবাংলা একটি আলাদা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হোক। এটা তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের জন্যে এখন আর কার্যকর থাকতে পারে না। কার্যকর থাকলে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে স্বাধীনতা হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। বরং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রত্যয় ও দর্শন দিয়েছেন, সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার একমাত্র দিকদর্শন। অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা বা মুসলমানিত্ব আছে। সুতরাং এটি একটি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। কিন্তু বিষয়টি যারা এভাবে দেখার চেষ্টা করেন, তারা ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম বলে আমার মনে হয় না। তাদের জানা উচিত, বোঝা উচিত, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান, তারা ইসলাম ধর্মে ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং মূল্যবোধ জড়িত যে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সেটাতে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের কথা যদি আমরা বলি এবং গণতন্ত্রে যদি মেজরিটির সংস্কৃতির ও মেজরিটির বিশ্বাসের গুরুত্ব গণতন্ত্রের কারণেই বেশি হয়, মেজরিটির মূল্যবোধের কথা বলে, তাহলে সেটাই গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বাংলাদেশে ডমিনেন্ট সংস্কৃতি হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। ডমিনেন্ট মূল্যবোধ হচ্ছে মুসলমানিত্ব এবং ইসলামী মূল্যবোধ। সেটিকে অস্বীকার যে জাতীয়তাবাদ করে, সেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদে যারা বিশ্বাসী, তারা পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য কী, এটা অনুধাবন করতে হয় অক্ষম, নতুবা তারা দুই বাংলার রাষ্ট্রীয় একত্রিকরণে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাসী। এ কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখের উত্সব পালনসহ বাঙালির উত্সব বলে যে সব সাংস্কৃতিক আচারকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতির, বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস ও বোধের কোনো প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করছি না। এই সমস্যাগুলো বিবেচনায় রেখেই রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে যেমন বাঙালিত্ব আছে, মুসলমানিত্ব আছে, তেমনি উপজাতিদের যে সংস্কৃতি—এরও স্বীকৃতি আছে, স্বীকৃতি আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ডমিনেন্ট সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রপতি জিয়া আমাদের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছেন। শহীদ জিয়া ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে এটা সংযোজন করেছেন এ কারণে যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মীয় চেতনার কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে অসাম্প্রদায়িকতায়। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না, কেননা সাম্প্রদায়িক হলে মুসলমানিত্ব থাকে না। সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম পরস্পরবিরোধী। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে ইহজাগতিকতাবাদ। ইসলাম ইহজাগতিকতাবাদে বিশ্বাস করে না। কেননা ইহজাগতিকতাবাদে পারলৌকিক জীবনের কোনো চেতনা নেই। উল্লেখ্য, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আচরণেই ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমন তাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়। তাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও আছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করে সরকার পরিচালনা করছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে জাতীয়তবাদের রাজনীতি যারা করছেন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা বার বার ক্ষমতায় এসেছেন। এর একমাত্র বড় কারণ হচ্ছে, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন শহীদ জিয়ার রাজনীতির উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া। শহীদ জিয়া যা করতে চেয়েছেন, যা করেছেন, যে আদর্শ দিয়েছেন, যে সততার উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন, সেগুলোর মধ্যে বেগম জিয়া বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশী রাজনীতির পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ করতে বহুলাংশে সমর্থ হয়েছেন।
শহীদ জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট অবস্থায় তাঁকে সেনাবাহিনীর বীর সদস্যরা ক্ষমতার আসনে নিয়ে আসেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি ক্ষমতাকে দেশের মানুষের কল্যাণে দায়িত্ব পালন হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মনের করেছিলেন, এটি হচ্ছে দেশের জনগণকে সেবা করার একটি সুযোগ এবং সেই সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। অনেকে সমালোচনা করার চেষ্টা করেন যে, তিনি সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তারা ভাবতে চান না যে, জন্মের চেয়ে কর্মই প্রধান বিবেচ্য। বিশ্বে যারা জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা লাভ করেননি। শহীদ জিয়া ক্ষমতায় আসার পর কী করেছিলেন, সেটিই মূল্যায়নের বিষয়, কীভাবে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেটি দেখার বিষয় নয়। কেননা বাংলাদেশেই উদাহরণ রয়েছে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা লাভের পর ওই সরকার কী পরিমাণ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল।
সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জোর করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই মুহূর্তে জাতির যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছিল জেনারেল জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করার ফলে। শহীদ জিয়ার কোনো রাজনৈতিক পাঠ ছিল না। তিনি নেতা ছিলেন না। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর তাঁর দেশপ্রেম, ইতিহাস চেতনা, সততা, কর্মোদ্যোগ এবং আদর্শিক প্রত্যয়ী বিশ্বাসের কারণে, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও, তিনি একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন উন্নয়নকামী নেতা হিসেবে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে গৃহীত হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তিনি একজন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়ক ও নেতা ইমেজে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হন। সার্ক প্রতিষ্ঠার চিন্তা-ভাবনা তাঁর মধ্য থেকেই শুরু হয় এবং তাঁরই চিন্তার ফসল হচ্ছে এই সার্ক।
রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি উন্নয়নের জন্যে অনেক বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করার জন্য নদীর তলদেশ ড্রেজিং ও সেচের জন্য খালকাটা কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। সেচ ব্যবস্থা দ্বারা আমাদের কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, নদী-নালার এই দেশ গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায় এবং কৃষি উত্পাদনের ক্ষেত্রে সেগুলো পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হয় না। একই সঙ্গে ক্রমান্বয়ে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। সে জন্যে তিনি খালকাটা ও নদী খনন কর্মসূচির দ্বারা কৃষিতে সম্প্রসারিত সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, যাতে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি পায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভারত বাংলাদেশে পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে যে কৃপণতার পরিচয় দিচ্ছে, বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য শেয়ার থেকে যেভাবে বঞ্চিত করছে, তাতে বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিকভাবে উঠে দাঁড়াতে হয় তবে গ্রামীণ সেচ ব্যবস্থা কার্যকর করার নিমিত্তে নদী, নালা ও খাল খনন করতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি অনেক প্রকল্প তখন হাতে নিয়েছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশে ক্ষমতায় যারা আসেন, তাদের মনে রাখতে হবে যে, শহীদ জিয়ার যত সমালোচনাই তারা করুন না কেন, বাংলাদেশে�

No comments

Powered by Blogger.