শোবার ঘরে খুন-খারাবি বাড়ছে, তদন্ত ঢিলেঢালা by এস এম আজাদ

শোবার ঘরটিও আর নিরাপদ ভাবা যাচ্ছে না। রাজধানীতে গত দুই বছরে এই শয়নকক্ষেই শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে জোড়া খুনের ঘটনা আছে পাঁচটি। এই ঈদের ছুটিতেও রাজধানীর বাসা-বাড়িতে তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।


শঙ্কার বিষয় হলো, এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে নগরবাসীর উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
রাজধানীতে গত বছরে সংঘটিত অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ সময়ে নিজ বাসায় কুপিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গৃহবধূসহ শতাধিক নারী-পুরুষকে। এসব আলোচিত ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। দু-একটি ঘটনায় সন্দেহজনক কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও প্রকৃৃত খুনিরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
আলামতের তথ্য, স্বজন ও পুলিশের বক্তব্যে জানা গেছে, বাসার মধ্যে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশির ভাগই পারিবারিক দ্বন্দ্বের বাইরের ঘটনা। তদন্তে ব্যক্তিগত বা সম্পত্তির বিরোধের ক্লু পাওয়া গেছে অনেক ক্ষেত্রে। চুরি-ডাকাতির ঘটনায়ও ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
গত দুই বছরে শোবার ঘরে হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ঘটনা। ঘটনার পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ আদালতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে। এরপর র‌্যাব তদন্তভার নিলেও এখনো খুনিরা রয়ে গেছে অন্তরালে।
গত বছরের ২৮ জানুয়ারি নয়াপল্টনের ফ্ল্যাট থেকে দৈনিক জনতার সিনিয়র সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তাঁর স্ত্রী রহিমা খানমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় ফরহাদ খাঁর ভাগ্নে নাজিমুজ্জামান ইয়নকে। কিন্তু নিহতের পরিবারের সদস্যরা মামলার তদন্তের শুরু থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ করছেন।
গত বছরের ৯ জানুয়ারি ইন্দিরা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে বৃদ্ধা ভার্জিনিয়া রোজারিও ও তাঁর ছেলে ভ্যালেন্টাইন রোজারিও মিল্টনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল ভার্জিনিয়ার গলাকাটা লাশ। আর খাটের সঙ্গে শিকলে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় মিল্টনের লাশ। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনো প্রকৃত দোষী কে, তা পুরোপুরি চিহ্নিত হয়নি।
চলতি বছরের ৩১ জুলাই দক্ষিণখানে সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার নাসির উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মুক্তাকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এক মাসেও এ জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
গত ২৯ জুলাই গুলশানে নিজ বাড়ির শয়নকক্ষে ব্যবসায়ী বৃদ্ধ ফজলুল হককে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সন্দেহজনকভাবে বাড়ির সাত কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করলেও রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, বাড়ির কর্মচারী সবুজসহ কয়েকজন জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।
গত ২২ জানুয়ারি মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে স্ত্রী-সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় পুঁজিবাজারের ব্যবসায়ী জিয়া হায়দারকে। নিহতের স্ত্রীর অভিযোগ, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে বাসায় এসে তাঁর স্বামীকে খুন করে গেলেও মূল আসামিদের ধরতে পারেনি পুলিশ।
২০১০ সালে যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের বাসায় মা সুফিয়া খাতুন ও স্ত্রী বীথি রহমানসহ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিল্টনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মিল্টনের ভাই ও ভাতিজাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে ডিবি পুলিশ। তবে নিহতের ছেলের দাবি, প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালেই রয়ে গেছে।
গত বছরের ১ এপ্রিল মিরপুরে নিজ বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় বৃদ্ধা নূরজাহান বেগমকে। এ ঘটনায় কয়েক দফায় বাড়িটির ভাড়াটিয়া, রিকশাচালকসহ কয়েকজনকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু আসল খুনি শনাক্ত হয়নি। গত বছরে ধানমণ্ডির বাসায় হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট নাজির আহমেদ খান এবং গ্রীন রোডে এনজিও পরিচালক আবুল কাসেম খুন হন।
গত বছরের ৮ জানুয়ারি গেণ্ডারিয়ার বি কে দাশ রোডে সন্ত্রাসীরা বাসায় এসে বিভূতি রঞ্জন দাসকে জবাইয়ে চেষ্টা করে। এ সময় তাঁর শিশুছেলেকে ড্রামের পানিতে চুবিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর পল্লবীতে নিজ বাসায় খুন হন স্কুলশিক্ষিকা আকলিমা আক্তার ওরফে রুবি। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর শেওড়াপাড়ার ফ্ল্যাট থেকে রমনা থানা মসজিদের পেশ ইমাম ইসহাকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর বনশ্রীতে বাসায় খুন হন গৃহবধূ সোমা আক্তার। ২ অক্টোবর মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের একটি ফ্ল্যাটে আলেয়া বেগমকে সন্ত্রাসীরা গলাটিপে হত্যা করে। গত বছর ৪ অক্টোবর বাড্ডায় ভাড়াটিয়াদের হাতে খুন হন বাড়ির মালিক নূরজাহান বেগম।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বাসা-বাড়িতে তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ১৭ আগস্ট রাতে পুলিশ মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়া এসপি রোডের বাসা থেকে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় কোহিনূর বেগম নামের এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করে। ১৮ আগস্ট মহাখালীর আমতলী হকার্স মার্কেটের পেছনে সড়ক ও জনপথ কোয়ার্টারের একটি সাবলেট বাসা থেকে হোটেল কর্মচারী নজরুলের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বনানী থানার ওসি ভুঁইয়া মাহবুব হাসান বলেন, 'স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। ঘটনার তদন্ত চলছে।'
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টারে শোবার ঘরে খুন হন নারায়ণ চন্দ্র দত্ত ওরফে নিতাই নামের এক চিকিৎসক নেতা। এ হত্যাকাণ্ডে সন্দেহজনক চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমে গতি নেই : মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি শাহীনবাগে নিজ বাসা থেকে উদ্ধার হয় গৃহকর্ত্রী শামীম আরা বেগমের লাশ। ঘটনার পর থেকে গৃহকর্মী পারভীন পলাতক। ২০১০ সালের ৮ মে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে নাছরিন নামের গৃহকর্ত্রীকে খুন করে গৃহকর্মী লিজা পালিয়ে যায়। একই দিনে কলাবাগানে গৃহকর্মী নূর ইসলামের হাতে খুন হন প্রকৌশলী গোলাম রহমান। এ ধরনের বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর গৃহকর্মী ও গাড়িচালকদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয় মহানগর পুলিশ। গত বছরের জুন মাসের অপরাধবিষয়ক সভায় গৃহকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীদের ছবি সংগ্রহের বিষয়ে তাগিদ দেন মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদ। নিজ নিজ থানা এলাকার কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশের মাধ্যমে তালিকা সংগ্রহ করতে বলা হয় স্থানীয় থানার ওসিকে। গৃহকর্তাদেরও নোটিশ দিতে বলা হয়। তবে এক বছরেও কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি।
পুলিশের দাবি, সচেতনতার অভাবেই অনেকে তথ্য দিতে চায় না। তবে মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলের প্রধান উপপুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, কার্যক্রমটি এখনো চলমান। যারা অপরাধ করে, তারা মিথ্যা তথ্য দিতে পারে। তাই ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। অপরাধ প্রতিরোধে বাড়ির দারোয়ান, গাড়িচালক ও কাজের লোকসহ কর্মচারী নিয়োগে অধিক সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। বাসায় সংঘটিত বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের খুনি শনাক্ত করতে পুলিশ সক্ষম হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এ নিয়ে নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আলামত নষ্ট হওয়া এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষার অভাবে কিছু ঘটনা শনাক্তে সমস্যা হয়।
চিকিৎসক হত্যা মামলা ডিবিতে

No comments

Powered by Blogger.