একটি অবিনশ্বর সন্ধ্যার কথা by তিতাশ চৌধুরী

সত্ সাহিত্য মরে না। অনাদিকাল বেঁচে থাকে। সাহিত্য পদবাচ্য হলে যে কোনো সাহিত্যই কালের দাপটে তলিয়ে যায় না কিংবা সাহিত্যের জোয়ারে ভেসে যায় না। আমি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০-এর একটি অবিনশ্বর সন্ধ্যার কথাই বলছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় অবিনশ্বর পত্রিকাকে ঘিরে যে সাহিত্যালোচনা হয়েছিল তার তুলনা রহিত। অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, অবিনশ্বর একটি লিটল ম্যাগ বা আমরা একে সাহিত্যপত্রও বলতে পারি।

কেননা লিটল ম্যাগ যে ধরনের কিংবা যে সাইজের হয়—অবিনশ্বর এর চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী একটি পত্রিকা। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা লিটল ম্যাগের মতো নয়। দেড়শ’ থেকে দুইশ’ কিংবা আড়াইশ’ পৃষ্ঠা এর কলেবর। সুতরাং সঙ্গত কারণেই একে লিটল ম্যাগ বলা ঠিক হবে না। যাক, যা বলছিলাম—ওইদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। অবিনশ্বর পত্রিকার জমকালো অনুষ্ঠানটাও সেদিন নানা কারণেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। ঘরোয়া আদলের অনুষ্ঠান হলেও তাতে লোক সমাগম কম ছিল না। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন একজন কথাশিল্পী ফরিদা হোসেন। ফরিদা হোসেন নিজেও বিখ্যাত নানা কারণে। তার বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, তার সাহিত্যচর্চা ও অনুশীলন এরই মধ্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি একা অবিনশ্বর নামক একটি সুন্দর ছিমছাম পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে মন জুড়িয়ে যায়—একজন মহিলা লেখকের হাত দিয়ে এমন একটি সুন্দর পত্রিকা বেরোচ্ছে। তাকে সহায়তা করছে এম রফিক। আমার ভালো লেগেছিল, সেদিন পত্রিকাকে ঘিরে একটি সুধী সমাবেশ দেখে। সত্যিই বিস্মিত হতে হয় এই কারণে যে, যদি আমি সেদিন আমার স্ত্রী নন্দিনীকে নিয়ে সে অনুষ্ঠানে না যেতাম তাহলে অনেক কিছুই মিস করতাম। ফরিদা হোসেনের দালানের তিন তলার ছাদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বাহারি ফুলে-ফলে ঘেরা ছাদটি বিদ্যুতের আলোতে আমাদের দৃষ্টিকে বিপুলভাবে এবং খাড়াভাবে আকর্ষণ করছিল। বিদ্যুতের রকমারি আলোতে আর ফটো তোলার আয়োজনে সারা অনুষ্ঠানে একটা চমক সৃষ্টি করেছিল। এই সুধী সমাবেশে কারা এসেছিলেন? আমার মনে হয়েছিল, পৃথিবীর যত জায়গায় বাঙালি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করছিলেন—তাদের প্রায় অনেকেরই এখানে সমাবেশ ঘটেছিল। ঢাকা থেকে শুধু কবি আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, আবদুল হাই শিকদার, মাহবুব সাদিকই নন—কানাডা, আমেরিকা, জাপান, সিঙ্গাপুর ছাড়াও আমাদের চট্টগ্রাম থেকেও অনেক সাহিত্যপাগল মানুষ ছুটে এসেছিলেন। সেজন্যই অনুষ্ঠানটি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল।
অনুষ্ঠানে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও বক্তৃতা, কবিতা, ছড়া, লিমেরিক ইত্যাদি পাঠের ব্যবস্থা ছিল। এই অনুষ্ঠানে পুরুষের চেয়ে মহিলার সংখ্যাই অধিক ছিল। এখানে সব মহিলাই সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত সাহিত্যমনা ছিলেন। লক্ষ্য করেছি, সবাই অনুষ্ঠানটিকে মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। অনুষ্ঠানে মোটামুটি সবাইকেই কিছু না কিছু বলতে হয়েছিল। অবশ্য সবার বক্তব্য, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি ভালো হয়েছিল। কেউ কেউ নিজের লেখা কবিতা আবার ইংরেজি করে শুনিয়েছেন। তিনি রুমানা চৌধুরী। তার বলার ঢঙটি আকর্ষণীয় ছিল। রাবেয়া সুলতানা, আরিফ চৌধুরী এবং অন্যদের আবৃত্তিও ভালো হয়েছে। একজন কবি অনুষ্ঠানে অনেক লিমেরিক আবৃত্তি করে শোনালেন। আমার ব্যক্তিগত লাভ হলো আমি এই অনুষ্ঠানে সালমা, রুমানা, রাবেয়া, পরাগ এবং আরও আরও কবি-শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। যে মেয়েটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেছিল—তার উপস্থাপনাও আকর্ষণ ছিল। এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ছিল কবি আল মাহমুদ ও কবি বেলাল চৌধুরীর বক্তব্য। কবি বেলাল চৌধুরী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে সুধীজনের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন। আর কবি আল মাহমুদের বক্তব্য ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শক্তি সম্পর্কে। কবি আল মাহমুদ চোখে ঠিকমত দেখেন না—তবু তার হাত নাড়া দেখে সবাই অবাক হয়েছেন— এখনও তিনি কত জীবন্ত, কত প্রাণবন্ত। এর আগে বেলাল ভাই বললেন, ‘আল মাহমুদই আমাদের বাংলাদেশের একমাত্র কবি যিনি গণনাযোগ্য, গণনাতুল্য। তার সমকক্ষ কবি সবদিক বিচারে আজ এ দেশে বিরল।
যে অবিনশ্বর পত্রিকাটিকে ঘিরে ১৪ ফেব্রুয়ারি যে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল, তা এক অর্থে সফল হয়েছিল। কবি আল মাহমুদ, কবি বেলাল চৌধুরী প্রমুখের আগমনই এই অনুষ্ঠানটিতে চমক সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগে কবি আল মাহমুদকে আমি আমার ‘দরবেশ ও দরগার কথা’, ছড়ার বই ‘তা ধিন ধিন’ উপহার দিলাম। বেলাল ভাইকেই সদ্য প্রকাশিত ‘অলক্ত’ পত্রিকা এবং কবি মাহবুব সাদিককে আমার অনূদিত বিদেশি কবিতা গ্রন্থ ‘অন্যস্বর’, আমার সদ্য প্রকাশিত ‘রঙ্গরসের গল্প’ ও ছড়ার বই উপহার হিসেবে দিলাম। এদিকে অনুষ্ঠান কিন্তু থেমে নেই। একজনের পর একজন বক্তৃতা দিচ্ছে, কবিতা আবৃত্তি করছে, ছড়া পাঠ করছে। যেন কোনো কিছু শেষ হতে চায় না। যে কথা বলতে ভুলে গেছি—এই সমাবেশে ভূরিভোজেরও বিপুল আয়োজন করা হয়েছিল। এটি গৃহস্বামী মোশারফ হোসেন এবং কথাশিল্পী ও অবিনশ্বর সম্পাদক ফরিদা হোসেন এই দু’জনের যুগ্ম ফসল। সেদিন আমাদের ক্যান্টনমেন্টের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা বেজে গিয়েছিল।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.