মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে- বিচার অঙ্গনকে ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে by বিকাশ দত্ত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখন নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অনেকেই বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের ওপর নজরদারি করতে হবে। তা না হলে যে কোন সময় বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে।


পাশাপাশি গোটা বিচারালয় অঙ্গনকে ২৪ ঘণ্টার জন্য সিসি টিভির আওতায় আনতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দুটি ট্রাইব্যুনালে এখনও সংশ্লিষ্টদের যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। সে কারণে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একাত্তর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল হুমকির মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, সিসি টিভি ক্যামেরাম্যান চাওয়া হয়েছে মাত্র একজন। সেখানে গোটা ট্রাইব্যুনাল ভবন, আঙ্গিনা ও প্রবেশপথে ২৪ ঘণ্টা সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায় নজরদারির জন্য কমপক্ষে ১০ জন অপারেটর প্রয়োজন।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গেটের সামনে বেশকিছু ছোটখাট দোকান রয়েছে। এ সমস্ত দোকান নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এখানে অনেক অপরাধীর আনাগোনা হয়। এ দোকানগুলো উঠিয়ে দেয়া একান্ত জরুরী। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালে যে সমস্ত পুলিশ রয়েছে তাদের কয়েকদিন পর পর বদলি করা হলে কারোর সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে উঠবে না। শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে আরও বলেছেন, যে সমস্ত সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসিকিউশন বিভাগে অনেক প্রসিকিউটরকে গাড়ি দিয়ে আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রসিকিউটরবৃন্দ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন।
জানা গেছে, প্রসিকিউটরবৃন্দ তাঁদের গানম্যান সঙ্গে নিয়ে চলাফেলা করতে পারছেন না। যারা রিক্সায় চলাচল করেন তাদের দুটি রিক্সা নিতে হয়। এক রিক্সায় প্রসিকিউটর অন্য রিক্সায় গানম্যান। এতে করে তাদের ঝুঁকিই থেকে যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রসিকিউটর বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আমরা লড়ছি। অথচ আমাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে কয়েক প্রসিকিউটরকে অনুসরণ করা হয়েছে। যদিও তাঁরা এখন পর্যন্ত থানায় জিডি করেননি।
প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জনকণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমানে প্রসিকিউশন বিভাগে ১৩ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। ডিএজি, এএজি সমপর্যায়ের যে সমস্ত প্রসিকিউটর আছেন তাদের গাড়ি দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে এক প্রসিকিউটর তাঁর ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এখানে পদমর্যাদাটা মুখ্য নয়, সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। গানম্যান আছে সে কিভাবে উঠবে। সবার জন্য সমান সুযোগ করে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাসায় কোন সিকিউরিটি নেই। সেখানে সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমরা আশা করছি, সরকার এটা নিজ দায়িত্বেই করবে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ বর্তমান ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের বিচার কাজ চলছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাশেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলীম। বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ সমস্ত প্রসিকিউটর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে আইনী লড়াইয়ে লড়ছেন। এখন পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবীরাই আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছে। জামায়াতের আইনজীবীদের প্রধান হিসেবে রয়েছে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। যদিও এর আগে জামায়াতের আইনজীবিগণ বিদেশ থেকে আইনজীবী আনার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হয়। জানা গেছে, যুগোসøাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেøাভোদান মিলোসভিচের আইনজীবী স্টিভেন কিউসি, সিয়েরা লিওনের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ডিফেন্স আইনজীবী জন ক্যামেগ, বসনিয়া হার্জেগভিনার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর টবি ক্যাডম্যান জামায়াত নেতাদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা বার কাউন্সিলের অনুমতি না থাকায় ঢাকায় আসতে পারছেন না। কারণ কোন বিদেশী আইনজীবীকে এখানে প্র্যাকটিস করার অনুমতি নেই। এখানে প্র্যাকটিস করতে হলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
বার কাউন্সিলে জামায়াতের আইনজীবিগণ বিদেশী আইনজীবী আনার জন্য একটি আবেদন করার পর ৬ দিনের মাথায় ২০১১ সালের ২৩ জুলাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের আবেদন নাকচ করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। এ্যাটর্নি জেনারেল ও বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহবুবে আলম সেদিন জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, আইনের আওতায় না আসায় তাদের আবেদন নাকচ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের পক্ষে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতের আইনজীবীরা বার কাউন্সিলে গত বছর ১৭ জুলাই আবেদন করেন। আবেদন নাকচ হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে বার কাউন্সিলের সনদ দেয়ার বিধান নেই। এ ছাড়া বারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সনদ দেয়ারও সুযোগ নেই। আদালতে মামলা পরিচালনা করতে হলে তাকে অবশ্যই বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে হবে। এর পর মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পরই বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইন পেশার সনদপত্র পাওয়া যায়। বার কাউন্সিলের সদস্য ছাড়া কেউ আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে না। সে কারণেই বিদেশী আইনজীবিগণ কোন অবস্থাতেই ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ৮ জনের সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রায় ২০ হাজার সাক্ষী দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেÑ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের পক্ষে ২ হাজার ৯৩৯ জন, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে ১০ হাজার ১১১ জন, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে ১ হাজার ৩৫৭ এবং আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষী ৯৬৫ জন, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে ৪৮ সাক্ষীর নাম দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে ১ হাজার ১৫৩ জন, আব্দুল আলীমের পক্ষে ৩ হাজার ৩২৮ জন। এ ছাড়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়া হবে ২৬ আগস্ট।
ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সারাদেশ থেকে প্রায় ৬৪০টি অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থায় এসেছে। অভিযোগগুলোর মধ্য থেকে মাত্র ৪টি ঘটনার বিষয় স্ক্যান করা হয়েছে। এই চারজন বর্তমানে জেলা কারাগারে আটক রয়েছে। ৪ জনের মধ্যে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার হাজী মোবারক শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা তদন্ত করছে।
তদন্তকারী সংস্থার সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, প্রথম দফায় যে ২০ জনের তালিকা হয়েছিল তার মধ্যে থেকে ১০ জনের বিষয়ে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। এখনও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন শীঘ্র দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান, খুলনার একেএম ইউসুফ, হবিগঞ্জের সৈয়দ কাওসারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ৬৪০টি অভিযোগ এসেছে। সেগুলো জনবলের অভাবে তদন্ত করা যাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ৩৫১ জনশক্তি অনুমোদন করলেই আমাদের তদন্ত কাজে গতি আসবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু জনকণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমানে মামলাগুলো এখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে চলতে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, মামলার গতি যেভাবে আছে, সেভাবে চললে হয়ত জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হতে পারে। অন্যদিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, যে মামলাগুলো বিচারাধীন সেগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করতে হবে। ওসব জায়গায় ঘাটতি আছে তা অতিসত্বর পূরণ করা প্রয়োজন। তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, সাক্ষী নিরাপত্তা আইন করতে কে বাধা দিচ্ছে। সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য দিতে আসছে না।
তদন্ত সংস্থায় যে ৬৪০টি অভিযোগ এসেছে এর মধ্য থেকে চারটি বিষয়ে স্ক্যানিং করা হয়েছে। সেগুলো হলেÑ খুলনা বিভাগের আফজাল মিয়া, রাজশাহী বিভাগের বাঘমারার মোঃ আজাহার আলী, রবিশাল বিভাগের গলাচিপার রুস্তম সিকদার ও চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাক্ষণবাড়িয়ার হাজী মোবারক হোসেন। হাজী মোবারক হোসেন বর্তমানে জামিনে রয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা সঙ্গে জড়িত চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সেপ্টেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। এরা দুজনই দেশের বাইরে থাকে। চৌধুরী মইনুদ্দিন থাকে ইংল্যান্ডে আর আশরাফুজ্জামান আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।

No comments

Powered by Blogger.