শেখ মুজিবের মতো বক্তৃতাবাজি করলে চলবে না by এবনে গোলাম সামাদ

রাজনীতি করতে হলে কিছু বক্তৃতা দিতেই হবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতা কমবেশি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা করতে হয় নিজের রাজনীতির উদ্দেশ্যকে জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য। শেখ মুজিবও বক্তৃতা করেছেন। শেখ মুজিবের বক্তৃতার বিষয় ছিল, সাবেক পাকিস্তানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কীভাবে অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অথবা হতে পারছে তাই।

শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন তা এখনো সবার কাছে স্পষ্ট নয়। শেখ মুজিব সম্ভবত চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দিতে। আমার মনে পড়ে, আমি যখন ১৯৭১-এর ২৯ অথবা ৩০ মার্চ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকতে চাই, তখন আমাকে সীমান্তের চৌকিতে গিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল—আপনি কি শেখ মুজিব ধরা পড়েছে বলে মনে করেন? আমি তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলি, আমি থাকি রাজশাহী, ঘটনাটা ঘটে থাকলে ঘটেছে ঢাকায়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তবে হতে পারে তিনি ধরা পড়েছেন। শেখ মুজিবকে নিয়ে একই প্রশ্ন করেন আমাকে, কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের বড় কোনো কর্মকর্তা। আমি তার প্রশ্নের উত্তর একইভাবে প্রদান করি। তবে পুলিশের বড় কর্তা আমাকে প্রশ্ন করেন যে, আমি কেন মনে করছি, শেখ মুজিব ধরা পড়েছেন। আমি তার প্রশ্নের উত্তরে বলি, ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীকে তদানীন্তন ভারতের ইংরেজ সরকার গ্রেফতার করে। গান্ধীজি পালাতে চেষ্টা করেননি। শেখ মুজিবও করেননি একই কারণে। শেখ মুজিব কতকটা গান্ধীবাদী। তিনি দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক। পুলিশের কর্মকর্তা আমাকে ছেড়ে দেন। কলকাতায় ছিলাম প্রায় নয় মাস। সুযোগ হয় একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলবার। আজ যখন পিছু ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়, শেখ মুজিবকে ভারত সরকার আসলে বিশ্বাস করতে পারেনি। সমপ্রতি চট্টগ্রামে কোনো এক সভায় ভারতের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার বলেছেন, শেখ মুজিবের মতো বক্তৃতা করলে হবে না। বক্তব্যকে বলতে হবে অনেক গুছিয়ে এবং আলোচ্য সূচি অনুযায়ী। তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভারত সরকার কী দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে মূল্যায়ন করে চলেছে। বাংলাদেশে এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের মতে, শেখ মুজিব হলেন জাতির জনক। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার সাহসী হলেন, এরকম একটি অশোভন মন্তব্য করতে। আর সরকারিভাবে আমাদের বর্তমান সরকার বিরত থাকল এর প্রতিবাদ করা থেকে। এটাকে বলতে হবে, দেশের জন্য খুবই লজ্জাকর একটা ঘটনা। দেশ কী চলছে ভারতের নির্দেশে? সবাই জানে, শেখ হাসিনা ভারতের প্রতি বিশেষভাবেই ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু ঠিক এতটা ভারতের নির্দেশে চলাকে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী না ভেবেই পারি না। এ সভায় আসামের একজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ দুঃখজনক মন্তব্যের জন্য দায়সারাভাবে ক্ষমা চান। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার বলেন, বাংলাদেশের আবার কয়েকজন ব্যবসায়ী নাকি উলফা নেতাদের টাকায় ব্যবসা করছেন। তাই বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের ভিসা প্রদানের আগে খোঁজ নিতে হচ্ছে অনেক কিছুই। ভারতে যেতে এদেশের ব্যবসায়ীদের ভিসা দিতে তাই বিলম্ব হচ্ছে। আসামের এই মন্ত্রীর মতে উলফা জঙ্গিরা নাকি চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুঁজি বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে আসাম থেকে। আর আসামবাসী এ জন্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ। একটি সাধারণ সভায় এসব কথা বলাকে কি খুবই গোছাল বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে? শেখ মুজিব কিছু অগোছালো কথা বলে থাকলে বলেছেন জনসভায়, বিশিষ্টজনদের সভায় নয়। আসামের মন্ত্রীর কথাও আমাদের কাছে মনে হয়েছে যথেষ্ট জনসভাধর্মী। তার বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশে উলফা নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকা এনে ব্যবসা করছেন, এর মূলে কি কোনো প্রমাণ আছে? প্রমাণ থাকলে ভারত সরকারের সেটা দেওয়া উচিত সরকারিভাবে; চট্টগ্রামে চেম্বার অব কমার্সের সভায় নয়। মন্ত্রী যেভাবে কথাটা বলেছেন, সেটা তিনি আসামে বলতে পারতেন, তার বিধানসভায়; বাংলাদেশে এসে নয়। উলফা গেরিলারা বিদেশে হাজার হাজার টাকা নিয়ে যেতে পারছে অবাধে। আর আসাম সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এতে গেরিলাদের সাংগঠনিক শক্তি পরোক্ষভাবে যেন মেনে নিচ্ছে আসাম সরকার। আসাম সরকার গেরিলাদের কর্মতত্পরতার কাছে হয়ে পড়েছে অসহায়; যেটা আগে আমাদের জানা ছিল না।
খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রামের চেম্বার অব কমার্সের নেতারা জানিয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনারের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ। আমরা তাদের এ কাজের প্রশংসা করি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১৭ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন। ভারতের কূটনীতিক শেখ মুজিব সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করলেন। এর একটা ভিন্ন তাত্পর্য তাই থাকা সম্ভব। ভারত সরকার পছন্দ করছে না, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে উন্নত সম্পর্ক গড়ে উঠুক। গড়ে উঠুক চীন থেকে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ। শেখ হাসিনা ভারতপন্থী বলে পরিচিত। কিন্তু তার এই চীনে যাওয়াটা নিশ্চয় হচ্ছে না ভারতের মনমত। ভারত সরকার তাই কিছুটা বিদ্রূপ করতে প্রয়াসী হচ্ছে শেখ মুজিব সম্পর্কে। এটা এক ধরনের কূটনীতিক চাপ প্রয়োগেরই প্রয়াস।
চীন যদি বাংলাদেশের পণ্য বিনাশুল্কে চীনের বাজারে বিক্রি হওয়ার সুযোগ দেয়। তবে বাংলাদেশ তা থেকে যথেষ্ট লাভবান হবে। চীনের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে জোরাল। সে ইচ্ছা করলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বল্পসুদে পুঁজি লগ্নি করতে পারে। যেটা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক সেটাকে মধুর বলা যেতে পারে না। কিন্তু চীনের সঙ্গে আমাদের কোনো ঐতিহাসিক সংঘাত এখনও ঘটেনি। চীন তাই সহজেই আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। ভারত যা পারে না। ভারত যত চেষ্টাই করুক, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটা উন্নত সম্পর্ক গড়ে উঠবেই। বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে রয়েছে সংঘাত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা ইচ্ছা করলে নিতে পারেন এরও সুযোগ। ভারত অনাবশ্যকভাবে বাংলাদেশের মানুষের মনকে ক্ষুব্ধ করছে। তসলিমা নাসরিনের মতো মহিলাকে ভারতের পত্র পত্রিকা এখনও দিতে চাচ্ছে প্রচার প্রাধান্য। এর ফলে কেবল বাংলাদেশের মানুষের মনেই নয়, ভারতের মুসলিম মনেও জাগছে প্রবল প্রতিক্রিয়া। চীনে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে কোনো হইচই নেই, কিন্তু ভারতে আছে। ভারতকে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বন্ধ করতে হবে নাক গলানো। শ্রদ্ধা করতে হবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে। পৃথিবীর বহু দেশেরই রাষ্ট্রধর্ম আছে। বাংলাদেশেরও রাষ্ট্রধর্ম আছে। রাষ্ট্রধর্ম থাকাটা নজিরবিহীন ঘটনা নয়। আমাদের বাড়ির কাছের রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। ইসলাম কেবল একটা ধর্ম, বিশ্বাস নয়। এটাকে মনে করা যায় একটা আর্থসামাজিক ব্যবস্থা হিসেবেও। কিন্তু ভারতের পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মকে নিয়ে সমালোচনা আমাদের ক্ষুব্ধ করে। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রধর্ম আছে। রাষ্ট্রধর্ম আছে নরওয়ের, সুইডেন, ডেনমার্কের মতো দেশে। এসব রাষ্ট্রের সমালোচনা করে না ভারত। ভারত কেবল সমালোচনা করতে ব্যস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়াকে। এরকম সমালোচনার ফলে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির পথে ভাবনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। চীন আমাদের রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সে চাচ্ছে আমাদের সঙ্গে উন্নত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে। দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও লেনদেন বাড়লে এমনিতেই সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.