৭ই মার্চের ভাষণ : অডিও-ভিডিওকরণ by ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, রমনার রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে আহুত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল নেতা, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণটি প্রদান করেছিলেন, তা শুধু ভাষণ হিসেবেই অনন্য বা অসাধারণ ছিল না, জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফসল স্বাধীনতা লাভেও অপরিসীম ভূমিকা


রেখেছিল। পৃথিবীর কোনো জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এমন বিস্ময়কর নজির সৃষ্টি হয়নি, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঘটেছিল। এই ভাষণটি শুধু স্বাধীনতাসংগ্রামকে এগিয়েই নেয়নি, প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাও বহন করেছে। ফলে ২৫ মার্চ আক্রমণকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে জনগণ ৭ মার্চের ভাষণে উচ্চারিত স্বাধীনতার ঘোষণাকেই চূড়ান্তভাবে ধরে নেয়, প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ২৬ মার্চের তারবার্তাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আনুষ্ঠানিক ঘোষণারই প্রতিধ্বনি মাত্র, ১০ এপ্রিল নবগঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃত করেছে, দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক নিয়ম-নিষ্ঠতা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ৭ মার্চ উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাই প্রতিদিন প্রচার করেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই চলেছিল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি এখন তিনটি মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি। এগুলো হচ্ছে, অডিও, ভিডিও এবং মুদ্রিত রূপে। তবে যে বিষয়টি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না তা হলো, এই ভাষণটির অডিও, ভিডিও ও মুদ্রণের প্রথম উদ্যোগগুলো আজকের মতো অনুকূল পরিবেশে ছিল না, কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও পায়নি। তখন ৯ মাস যুদ্ধের একটি বৈরী পরিবেশ ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দালিলিকীকরণের উদ্যোগহীনতা ছিল। পঁচাত্তরপরবর্তী দীর্ঘ প্রতিকূল ও বৈরী রাজনৈতিক সময় ছিল এবং বর্তমানে চলছে শুধুই প্রচারপ্রিয়তা। কিন্তু একবারও ভেবে দেখা হচ্ছে না এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দলিলের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা কতটা প্রয়োজন। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ দলিল হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অভিও, ভিডিও এবং লিখিত রূপগুলো সর্বত্র অভিন্ন থাকতে পারছে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদি উৎস থেকে অদৃশ্যভাবে কিছু কিছু বিচ্যুতি ঘটে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ব্যাপক কোনো প্রস্তুতি নিয়ে অভিও-ভিডিও করা যায়নি। যতটুকুও করা গেছে ততটুকুকেও সমন্বিতভাবে প্রচার বা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে সরাসরি প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপে তা সেদিন প্রচারিত হতে পারেনি। এর চিত্রায়ণও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ ধরনের ভাষণ ধারণ করার মতো প্রযুক্তিও তখন তেমন বিশেষ ছিল না। যা ছিল তা বেশ ভারি ও আয়তনসমৃদ্ধ ছিল। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলবেন, তাও আগে থেকে নির্ধারিত বা ঘোষিত ছিল না। তবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন, দিক নির্দেশনা দেবেন- এমন আভাস ছিল, ধারণা ছিল। দেশি-বিদেশি মিডিয়াগুলো সভাস্থলে তাই আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। তখন অবশ্য আজকের মতো ভিডিও ক্যামেরা তেমন ছিল না। ফটো সাংবাদিক এবং রিপোর্টাররা ছবি এবং সংবাদ সংগ্রহ করতেন। তেমন পরিস্থিতিতে কথা ছিল বাংলাদেশে বেতার বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সরাসরি প্রচার করবে। তাদের সে ধরনের প্রস্তুতি ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ। তাঁরা আগেই সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক ভাষণের রেকর্ডিং করতে হবে। একই সঙ্গে দৃঢ় ছিলেন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের (ডিএফপি) কর্মকর্তা (পরে অভিনয়শিল্পী হিসেবে খ্যাত) মরহুম আবুল খায়ের। তিনি সচল ক্যামেরা বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের গোলাপগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমএনএ ছিলেন, তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ফিল্ম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, 'জয় বাংলা' ফিচার ফিল্মের তিনি প্রযোজকও ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তখন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ছিলেন এনএইচ খন্দকার। সিদ্ধান্ত হয় যে আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে এনএইচ খন্দকার মঞ্চের নিচে তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে বক্তৃতা ধারণ করবেন। ডিএফপি কর্মকর্তা আবুল খায়ের মঞ্চের এক পাশে সচল ক্যামেরা নিয়ে চিত্র ধারণ করতে থাকেন। ক্যামেরার আকার বড় থাকায় খুব বেশি নড়চড়া করতে তিনি পারছিলেন না। বিশেষত ভাষণের পরিবেশ শুরু থেকে শেষ অবধি এতটাই আবেগ, উত্তেজনা ও দৃষ্টিকাড়া ছিল যে কোনো ক্যামেরাম্যানের পক্ষেই নড়াচড়া করার তেমন সুযোগ ছিল না। সে কারণে তিনি একটা দূরত্বে থেকে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার দৃশ্য যতটুকু পেয়েছেন ততটুকুই ধারণ করেছেন। ফলে দেখা যায় বক্তৃতার ভিডিও দৃশ্যটি ১০ মিনিটের। অন্যদিকে আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে মঞ্চের নিচে এ এইচ খন্দকার সম্পূর্ণ ভাষণের কথাই রেকর্ড করতে সক্ষম হলেন। বেতারের কর্মকর্তারাও ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারলেও এটির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড করাতে তাঁরা সক্ষম হন, যা পরদিন বেতারকর্মী এবং জনগণের দাবির কারণে বেতার থেকে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এইচএম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাষণটির একটি রেকর্ড প্রকাশের ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণের একটি রেকর্ড নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন। তিনি এর একটি কপি উপহার দিলে বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুই এত বড় কাজ কিভাবে করলি?' বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন তরুণ আরেক এমএনএ তোফায়েল আহমেদ ছিলেন। তিনি খায়ের সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন, খায়ের ভাই, এই রেকর্ড বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবেন, এর রয়ালটি তো আওয়ামী লীগও পেতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ ভাষায় মজা করে বললেন, 'গলা আমার, ভাষণ-আমার, রয়ালটি পেলে তো আমাকেই দিতে হবে।'
এর পর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ভাষণের ৫০০টি রেকর্ড ৪৮, ইন্দিরা রোডস্থ অফিসের নিচে বস্তায় যত্ন সহকারে মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। কয়েকটি রেকর্ড কলকাতায় পাঠানোরও ব্যবস্থা করা হয়। হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) কম্পানি রেকর্ডটি এপ্রিল মাসে পায়। তারা এর তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি তখন বহির্বিশ্বে বিতরণের ব্যবস্থা করে। ঢাকা থেকে রেকর্ডটি 'ঢাকা রেকর্ড' নামে প্রকাশিত হয়। এই রেকর্ডে ভাষণটি যৎসামান্য সম্পাদনা করা হয়, যে সব বক্তব্য ভাষণে দুবার উচ্চারিত হয়েছিল, তা একবার রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটি দুবার উচ্চারিত হয়েছিল। 'ঢাকা রেকর্ড' তা একবার রেখেছিল। অন্যদিকে ঢাকা বেতার তা অটুটু রেখেছিল। তবে ঢাকা বেতারের কপিটি নানা বাধা-নিষেধের কারণে বাইরে প্রচারে তেমন আসতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা রেকর্ডটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং স্বাধীনতার পর নানাভাবেই প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পায়। এটি তাই সর্বাধিক প্রচারিত অভিও ভাষণ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মাত্র দুটো প্রতিষ্ঠান রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে এর সচল দৃশ্য ধারণ করেছিলেন মাত্র একজন, তিনি অভিনয়শিল্পী মরহুম আবুল খায়ের। দেশি-বিদেশি কোনো সাংবাদিক হয়তো ভাষণের খণ্ডিত কিছু অংশই ধারণ করেছিলেন। ফলে ভিডিওতে ভাষণের অতিরিক্ত দৃশ্য খুঁজে পাওয়া বেশ দুঃসাধ্যের ব্যাপার। সেটি সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। প্রয়োজন ছিল ঢাকা রেকর্ড এবং বেতারের রেকর্ড থেকে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ ভাষণটির একটি প্রামাণিকরণ। আবুল খায়ের এমএনএ এখনো বেঁচে আছেন। তিনি যমুনা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল তাঁর পুত্র। অভিনেতা আবুল খায়ের অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই আবুল খায়ের, সালাহউদ্দিন এবং এন এইচ খন্দকারের মতো মানুষ না থাকলে ১৯৭১ সালে আমরা হয়তো ইতিহাসের এমন মহামূল্যবান সম্পদ পেতামই না। তাঁদেরকে আমাদের স্যালুট।
বঙ্গবন্ধুর এমন ঐতিহাসিক ভাষণটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে মুদ্রিত হয়েছে। এমন একটি ভাষণ এভাবে মুদ্রিত হওয়া মোটেও প্রত্যাশিত নয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা, যে কমিটি ভাষণটির টেপ বা রেকর্ড ও মুদ্রিত সামগ্রী যাচাই-বাছাই করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দেবে; যা ভাষণটির প্রকৃত আকারটি ধারণ করবে। লক্ষ করলে দেখা যায়, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৭০৩-৭০৫-এ যে ভাষণটি স্থান পেয়েছে তা সূত্র হিসেবে 'জয় বাংলা' বিশেষ সংখ্যা এবং টেপ রেকর্ড থেকে লিপিবদ্ধ বলে লেখা থাকলেও সেটি প্রামাণিকরণ হয়েছে বলে মনে হয় না। আরো কিছু গ্রন্থেও ভাষণটির মুদ্রিত রূপ স্থান পেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অমিল চোখে পড়ে, যা মোটেও কাম্য নয়। আসলে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে এটিকে দেখা ও ব্যবহার করা। এর অডিও, ভিডিও এবং মুদ্রিত উপাদান অভিন্ন হতে হবে, একাত্তরের আদি উৎসে যাওয়ার ও পাওয়ার চেষ্টা সমাপ্ত করতে হবে, এর পর এর একটি রাষ্ট্রীয় দালিলিক মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। বাজারে এর খণ্ডিত সামগ্রীগুলো তা হলেই কেবল বিদায় নিতে বাধ্য হবে। এখন আমাদের অজান্তে ও অলক্ষে যৎসামান্য হলেও বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণাঙ্গ ভাষণই আমরা বহন করে চলেছি। আশা করি, সরকারই যথা শিগগির যথাযথ উদ্যোগ নেবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
patwari54@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.