সিদ্ধিরগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পাচ্ছে সেই আইসোলেক্স

এত কিছুর পরও সেই আইসোলেক্স স্যামসংয়ের সঙ্গেই সিদ্ধিরগঞ্জের ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয় চুক্তি করতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর তা করা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুসারে। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, গত ৩ মার্চ পারফরম্যান্স গ্যারান্টির টাকা জমা দিয়েছে প্রকল্প নির্মাণের জন্য মনোনীত প্রতিষ্ঠান আইসোলেক্স।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতাও কেটে গেছে। খুব শিগগির চুক্তি সম্পন্ন হবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিদ্যুৎসচিব আবুল কালাম আজাদ। তবে প্রকল্পের পুরো টাকা বিশ্বব্যাংক দেবে কি না তা নিশ্চিত করেননি তিনি।
বিদ্যুৎসচিবের ভারত সফরের অভিজ্ঞতা ও অর্জন তুলে ধরার লক্ষ্যে গতকাল সকালে বিদ্যুৎ ভবনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ সময় সচিব ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিসহ নানা সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। পরে এক প্রশ্নের জবাবে সিদ্ধিরগঞ্জ প্রকল্পের অগ্রগতির কথা জানান। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও পিডিবির চেয়ারম্যান এস এম আলমগীর কবীর উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, কালের কণ্ঠে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর 'ভোল বদল : এবার আবুলের পক্ষেই বিশ্বব্যাংকের তদবির' শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বিতর্কিত সাবেক যোগাযোমন্ত্রী আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের এই বিশাল কাজটি দেওয়া হলে সরকারের গচ্চা যাবে নগদ ৩০০ কোটি টাকা। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রতিষ্ঠান কোবরা আইসোলেক্স থেকে ৩০০ কোটি টাকা কমে কাজটি করতে চেয়েছিল। পিডিবি দুটি প্রতিষ্ঠানকেই অযোগ্য ঘোষণা করলেও বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ নির্মাণের জন্য মনোনীত করেছে আইসোলেক্সকে।
আইসোলেক্সের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। সিদ্ধিরগঞ্জের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আইসোলেক্সকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অজ্ঝালেন গোল্ডস্টেইন গত বছরের ৩১ মার্চ বিদ্যুৎসচিব আবুল কালাম আজাদকে প্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখিত একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে আইসোলেক্সকে কাজটি দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎসচিবকে অনুরোধ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে সন্তোষজনক মূল্যে চুক্তি হয়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ২ দশমিক ৪ রুপি। সঞ্চালন ব্যয়সহ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের ব্যয় পাঁচ টাকার মধ্যে থাকবে বলে জানান বিদ্যুৎসচিব। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারত ইতিমধ্যেই ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র শনাক্ত করেছে বলেও জানানো হয়। এসব কেন্দ্র থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এ বিদ্যুৎ দেশে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা জানান, 'এখনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।'
ভারত থেকে বাকি ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারেও অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চলতি মাসেই এ বিষয়ে একটি উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যেই এ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। নির্মাণাধীন কুমিল্লা-ত্রিপুরা সংযোগ লাইন দিয়ে এ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে। এ ছাড়া ত্রিপুরার বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবারের ভারত সফরে।
গত ১ মার্চ ভারতের দিল্লিতে রোড শো ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিষয়টি উল্লেখ করে সচিব বলেন, সেমিনারে শতাধিক বিনিয়োগকারী উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয় সেমিনারে। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৪ জন বিনিয়োগকারী সেমিনার শেষে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছেন বলে জানানো হয়। ফলে ভারত থেকে অনেক নতুন বিনিয়োগ আসবে বলে বিদ্যুৎসচিব আশা প্রকাশ করেন।
রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিরও অগ্রগতি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। চলতি মাসেই দুই দেশের সমন্বয়ে যৌথ কম্পানি বাংলাদেশে নিবন্ধিত হবে বলে জানানো হয়। এরপর আগামী মাসেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।
এদিকে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তেল ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক কম্পানি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। ইতিমধ্যেই এ প্রস্তাব সরকারের সম্মতি মিলেছে বলে জানান পিডিবির চেয়ারম্যান। বিপিসির ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি উদ্যোগে তেল আমদানির বিষয়ে কাজ করবে এ কম্পানি।
সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বহুদিন থেকে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইসিজিবি) ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে নানা টানাপড়েন চলে। পুনর্মূল্যায়িত এ প্রকল্পের জন্য ৪১৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যার পুরোটাই দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। গত ১২ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংক এক পত্রে ইজিসিবিকে জানায়, তারা এ প্রকল্পের জন্য ২২১ মিলিয়ন অর্থ দিতে পারবে। বাকি অর্থ বাংলাদেশকেই জোগাড় করতে হবে। ইজিসিবির কম্পানি সচিব কাজী নজরুল ইসলাম ১৫ জানুয়ারি একটি পত্রে বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে অবহিত করেন।
২০০৯ সালে ইজিসিবি সিদ্ধিরগঞ্জে পিকিং প্লান্ট হিসেবে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কেন্দ্রের জন্য দরপত্র ডাকে। এ সময় জার্মান কম্পানি সিমেন্স সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। কিন্তু সিমেন্স ঠিকাদার হলে ঋণ দেবে না বলে জানায় বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শেই পিকিংয়ের বদলে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট হিসেবে ২০১০ সালের নভেম্বরে আবার টেন্ডার ডাকে ইজিসিবি। এবার দরপত্রে দুটি কম্পানি অংশ নেয়। একটি হলো স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার আইসোলেক্স-স্যামসং জেভি, অন্যটি ফ্রান্সের কোবরা। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কোবরা ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং আইসোলেক্স-স্যামসং ৩৪২ মিলিয়ন ডলারে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দর প্রস্তাব জমা দেয়। পরবর্তী সময়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দেখতে পায়, সর্বনিম্ন দরদাতা কোবরা দর প্রস্তাবে 'অপ্রয়োজনীয়' তথ্য উল্লেখ করেছে। আর আইসোলেক্স-স্যামসংয়ের এ ধরনের কাজে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এ অবস্থায় কমিটি উভয় প্রতিষ্ঠানকে 'অযোগ্য' বিবেচনা করে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি এ ব্যাপারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের মতামত চেয়ে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক আইসোলেক্সকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে মত দেয়।

No comments

Powered by Blogger.