বাংলাদেশ ফুটবলের উন্নতি চোখে পড়েছে ব্ল্যাটারের

আতিথেয়তায় তিনি মুগ্ধ। ছবিতে আমাদের ফুটবল ঐতিহ্য দেখে শিহরিত। সবে মিলে বাফুফে ভবন চত্বরে খোলা আকাশের নিচে ভীষণ খোশ মেজাজে সেপ ব্ল্যাটার। সুবাদে কাজী সালাউদ্দিনও রোমাঞ্চিত। তাঁরা দুজন পূর্বপরিচিতও, কিন্তু সম্পর্কের বন্ধনটা জোরালো হলো নতুন প্রেক্ষাপটে; বিশ্ব ফুটবলের নবরাজনীতির অঙ্গনে।


সেই অঙ্গনের সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তিত্ব ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটারের কণ্ঠে উদারতা। ফুটবলে পিছিয়ে থাকা এ জাতিকে টেনে তুলতে তিনিও উদারহস্ত হবেন। আপাতত ফিফা সঙ্গী হয়েছে সিলেটের নতুন ফুটবল একাডেমীর। বাফুফের সামনে মঞ্চে বসে তার 'ডিজিটাল' উদ্বোধনের আগে ফিফা প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেছেন, 'এটা হবে এ দেশের ভবিষ্যৎ ফুটবলার তৈরির কারখানা। কারণ এ দেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ, এখানে ফুটবল প্রতিভা আছে এবং সামনে অবশ্যই ভালো ফুটবল খেলা হবে।' এখানকার ফুটবল আবার মাঠে ফিরিয়ে আনবে তার সোনালি অতীতকে। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির ছবি প্রদর্শনীতে তিনি দেখেছেন সালাউদ্দিন-সালামদের মাঠ মাতানো ফুটবল। দেখেছেন সেই সময়ে ফুটবল মাঠে গণমানুষের মিছিল। সুতরাং ফিফা প্রেসিডেন্টের বিশ্বাস, এ দেশের ফুটবলে আবার নবজাগরণ হবেই, 'বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দিকে তাকাও, যে লেবানন দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে তাদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ উন্নতি হচ্ছে, সঠিক পথেই চলছে এ দেশের ফুটবল।'
হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে এ দেশের মহিলা ফু্টবলও। ঢাকার মাঠে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচের ছবিগুলো তিনি দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এবং ফুটবলে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, 'ফুটবলে কোনো সীমানা নেই। এই খেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।' তাই বলে এখনই বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বপ্নটা বাংলাদেশকে মানায় না। সেটি বাফুফেও দেখে না; এর পরও সহ-আয়োজক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবাদ সম্মেলনে। এমন প্রশ্ন শুনে ফিফা প্রেসিডেন্ট একটুও না ভেবে জবাব দিয়েছেন এভাবে, 'বিশ্বকাপে সহ-আয়োজকের নীতিও নেই ফিফার। তা ছাড়া ২০২২ বিশ্বকাপ হবে এশিয়ায়, সুতরাং পরেরটা হবে এশিয়ার বাইরে। ২০৩০-এ আবার এশিয়ার হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, বিশ্বকাপের চিন্তা না করে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবতে পরে। সে ক্ষেত্রেও চারটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম অবশ্যই দরকার হবে।'
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সেপ ব্ল্যাটার ঢাকায় এসে পৌঁছে দেখেন বিমানবন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনার ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাফুফে কর্মকর্তারা। সেই অভ্যর্থনাতেই ফিফা প্রেসিডেন্ট বিগলিত, বক্তৃতায়ও বারবার বলেছেন সেই আন্তরিক অভ্যর্থনার কথা। বক্তৃতা শেষে ফুটবল একাডেমী উদ্বোধনের পাশাপাশি তিনি নতুন টার্ফেরও উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন। অনেক হ্যাপা পার করে বাফুফে ভবনের পাশে বালুর মাঠকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম ঘাসের চাদরে। ফিফা গোল প্রজেক্টের আওতায় তৈরি এই মাঠে গিয়ে ব্ল্যাটার বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবলও খেলেছেন। বাচ্চারা তাঁর খুব প্রিয়, সব জায়গায় গেলে বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলেন তিনি। কিন্তু কালকের খেলাটা তাঁর মনের মতো হয়নি সংগঠক ও আলোকচিত্রীদের হুড়োহুড়িতে।
যৌবনে ফুটবলার ছিলেন। পরে হাত পাকিয়েছেন ফুটবল প্রশাসনে। এমনই পাকিয়েছেন- এখন সেপ ব্ল্যাটার নামেই ফুটবল বিশ্ব আলোড়িত হয়, আন্দোলিত হয়। এই নামে কুর্নিশ করে এখন ২০৮টি দেশ। করবে না-ই বা কেন, মঞ্চে উঠে ৭৬ বছর বয়সী প্রবীণ এই ফুটবল সংগঠকের ১০ মিনিটের বক্তৃতায় চারদিকে ধন্য ধন্য রব। এমনই মোহিত সবাই! ফুটবল বিশেষজ্ঞের বক্তৃতা ধরলে তা চমৎকার। রসবোধের দিক থেকে বিবেচনা করলেও অসাধারণ। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ব্ল্যাটার যেভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য হাততালি চাইলেন, সেটাই এর প্রমাণ। মানে এই অঞ্চলে ফুটবলের উন্নতির জন্য সরকারের সহযোগিতাও যে জরুরি একটা ব্যাপার, সেটা তিনি ভালোই বোঝেন।
আবার অনুষ্ঠান শেষের ঘোষণা শুনেই ফিফা প্রেসিডেন্ট হই হই করে ঘোষককে থামিয়ে দিয়ে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। চমকটা হলো তাঁর তরফ থেকে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সহযোগিতার ঘোষণা, 'মার্চের শেষের দিকে ফিফা ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভা আছে। এই সভায় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ একটি প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হবে।' শুনেই হাততালিতে মুখরিত হয় বাফুফে প্রাঙ্গণ। এ-মুখ, ও-মুখ হয়ে সেই বিশেষ প্রকল্পকে ধরার চেষ্টা করেও ধরা যায়নি। জানেন না বাফুফের উৎসাহী কর্মকর্তারাও। কিন্তু সেই সাহায্যে কি বাংলাদেশের ফুটবলের চেহারা পাল্টে যাবে? মোটেও না। কারণ ফিফা প্রেসিডেন্টের দর্শন হলো, 'আমরা আর্থিক ও টেকনিক্যাল সহযোগিতা দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের পাশে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটা আপনাদেরই করতে হবে। পবিত্র গ্রন্থেও আছে- যে নিজেকে সাহায্য করে, স্বর্গ তারই ঠিকানা হয়।'
সুতরাং ব্ল্যাটারকে দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্গারোহণ হবে না; তা করতে পারে একমাত্র বাফুফেই।

No comments

Powered by Blogger.