কালান্তরের কড়চা-৭ মার্চ : ৪১ বছর আগে ও পরে by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার বিশ্বখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক পল রবসনের একটা গান শুনেছিলাম। পরে কবিতা আকারে তার বাংলা অনুবাদ পড়েছি কলকাতার 'পরিচয়' পত্রিকায়। এই গান বা কবিতার কয়েকটি লাইন আমার মনে আছে : '(আমি) কালো বলে বন্দি ছিলাম ঘৃণার ঘোরে তুমি আমায় জাগিয়ে দিলে সূর্য ওঠার নতুন ভোরে তোমার কণ্ঠে বজ্র ছিলো চোখে ছিলো অগ্নিকণা সামনে ছিলো গণবাসুকির উদ্যত সব লক্ষ ফণা।'


আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকায় রমনায় রেসকোর্সে লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি দিচ্ছিলেন, তখন আমিও ছিলাম স্বাধীনতাকামী এক বাঙালি যুবক। আমার বুকেও এই ভাষণ বিষাণের মতো বেজে উঠেছিল। আমার চোখের সামনে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের চেহারা থেকে এক অলৌকিক দেবমূর্তিতে তখন রূপান্তরিত হয়েছিলেন। আমার কানে বেজে উঠেছিল, পঞ্চাশের দশকে শোনা পল রবসনের গান। রমনা ময়দানের অদূরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট (তখন নাম ছিল ইসকান্দার মির্জা হল) থেকে চারদিক ঘিরে ছিল সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের দিকে চেয়ে মনে মনে বলেছি, বাঙালি বলে আমাদের ঘৃণার ডোরে তোমরা বন্দি করে রাখবে, সেদিন তোমাদের ফুরিয়েছে।
লাখ লাখ মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিল। মুহুর্মুহু উঠছিল আকাশ-কাঁপানো জয়ধ্বনি। উচ্চ মঞ্চে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুকে মনে হচ্ছিল, ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসা দেবমূর্তির মতো। তেমনি আলোকিত, তেমনি মহিমান্বিত। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ একবার প্যারিসের মঞ্চে সরোদ বাজিয়েছিলেন। সেই বাজনা সম্পর্কে 'টাইমস্' পত্রিকা মন্তব্য করেছিল- �He (Allauddin) looks like a negro, but when he play, he looks like a god.� (তিনি দেখতে নিগ্রোদের মতো। কিন্তু তিনি যখন বাজান, তখন তাঁকে দেবতার মতো দেখায়)। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা যায়, তিনি দেখতেও সাধারণ বাঙালির মতো ছিলেন না। ছিলেন ছয় ফুট লম্বা অসাধারণ বাঙালি। আবার যখন তিনি জনতার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতেন, তখন আরো অসাধারণ ও অলৌকিক হয়ে উঠতেন। তখন তাঁর একমাত্র পরিচয় 'জনগণমন অধিনায়ক'।
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, আমি ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা নেতাকে দেখেছি। তাঁর সানি্নধ্য পেয়েছি। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছি। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনা এবং তা রিপোর্ট করার পর এক মার্কিন সাংবাদিক লিখেছিলেন, 'লিঙ্কনের এই ভাষণ শোনা ও তা লেখার পর মনে হচ্ছে, আমার সাংবাদিকতা এখানেই শেষ হলে ভালো হয়। কারণ, আমি একটি ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে গেছি।' আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি স্বকর্ণে শোনার পর এবং তা নিয়ে অৎস্র লেখা লেখার পর আমিও সাংবাদিকতায় ইতি টানলে ক্ষতি ছিল না। কারণ, আমিও একটি ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে গেছি এবং অন্তর্গত হয়ে আছি।
মার্চের সেই অগি্নঝরা দিনগুলোতে যখন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলছে, তখন সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের সম্পাদনায় 'স্বরাজ' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোত। এই পত্রিকায় আমি এটি কবিতা লিখেছিলাম; তার কয়েকটি লাইন ছিল :
তোমার হাতে অস্ত্র আছে আমার হাতে অস্ত্র নেই
তাই বলে কি ভাবছো হবে রক্ত নদী পার?
দুঃশাসনের হে ক্রীতদাস, তোমার জানি হার হবেই
আমার বুকে স্বাধীনতার দারুণ অহংকার।
এই স্বাধীনতা কথাটিই বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণে। বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।' বস্তুত এটিই বাঙালি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা। পরবর্তী ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ৭ মার্চই তাই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার দিন। ৭ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন। পরবর্তী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ চলেছে, তা এই স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ।
লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ঘোষণার মতো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণারও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকার ঐক্য রক্ষায় গেটিসবার্গ ঘোষণা যেমন মার্কিন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুর '৭১ সালের ৭ মার্চের ঘোষণা বহুধা বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঘোষিত স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাঙালির মধ্যে এমন ঐক্য বহু শতাব্দীতে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন নেতাও আর বহু শতাব্দীতে বাংলাদেশে জন্মাননি। এ জন্যই তাঁর সম্পর্কে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক লিখেছিলেন, 'হাজার বছরের লোকায়ত বাংলার ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করেছে এবং তিনি আবার নতুন করে বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস তৈরি করেছেন।' আমার মতেও তিনি যে ইতিহাসের সৃষ্টি এবং নিজেও ইতিহাসের স্রষ্টা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই ইতিহাস তৈরির ৪১ বছর পর আমরা আজ ২০১২ সালে আরেকটি ৭ মার্চ উদ্যাপন করছি। এই ৪১ বছরের ব্যবধানে ৭ মার্চের চরিত্র ও চেহারাটি অবিকল আছে, না বদলে গেছে, তা হয়তো এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন। আমার মতে, ৭ মার্চের আবেদন ও আহ্বান এখনো বদলায়নি। কিন্তু তার পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ছিল একটি নিরস্ত্র জাতির ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করার দিন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর পেছনে দলমতনির্বিশেষে সব বাঙালি (হানাদারদের কিছু কোলাবোরেটর ও দেশদ্রোহী ছাড়া) ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে হাজার বছরের লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও কৃষ্টির ভিত্তিতে বাঙালি- এই এক পরিচয়ে বাংলাদেশের মানুষ মাথা তুলেছিল। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের কারাগারে বসে দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বসে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে দুটি অবিস্মরণীয় স্লোগান। এই যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বাঙালির জয় হয়েছিল।
আর ৪১ বছর পর ৭ মার্চ উদ্যাপন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ৭ মার্চ আছে, স্বাধীন বাংলাদেশও আছে। কিন্তু তার স্বাধীনতা কীটদুষ্ট। বাঙালির চরিত্র বিভক্ত ও পরিবর্তিত। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে ভেদ করে ধর্মীয় জাতীয়তার পরিত্যক্ত খোলস বাংলাদেশি জাতিসত্তা (নাগরিকত্ব নয়) নাম নিয়ে আবার আবির্ভূত হয়েছে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণার যে লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতার যে রূপরেখা ছিল- তা আজ বর্জিত ও বিতর্কিক। তবু সাম্প্রদায়িকতা নয়, ধর্মান্ধতা ও হিংস্র মৌলবাদ আজ দারুণভাবে মাথা তুলেছে। বিপথগামী জাতিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও কালো টাকা দারুণভাবে গ্রাস করেছে। স্বাধীনতার সংগ্রামে একদা যে বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছেন, আত্মদান করেছেন, তাঁরা আজ বিভক্ত এবং তাঁদের অনেকে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের কাছে আত্মবিক্রীত। সবচেয়ে বড় কথা, পেট্রো ডলার ও কালো টাকার কাছে সারা জাতির বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ আজ জিম্মি।
৭ মার্চের আহ্বান ছিল বাঙালির যে সেক্যুলার মডার্ন নেশন স্টেট প্রতিষ্ঠা, সেই লক্ষ্য থেকে জাতি আজ বিচ্যুত। তার বদলে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক কালচার আবার জাতীয় রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। সেক্যুলারিজম ও ডেমোক্রেসির পতাকাবাহী অনেক রাজনৈতিক দল, এমনকি ৭ মার্চের লেগাসি বহনকারী আওয়ামী লীগের রাজনীতিও আজ ধর্মীয় কালচারের প্রভাবাধীন। বাংলাদেশের বহিরঙ্গ এখন আধুনিক ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু ভেতরের আসল রূপ মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জাতীয়তাভিত্তিক এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি রাষ্ট্রব্যবস্থার। ৭ মার্চের আবেদন এখানে ব্যর্থ।
এবারের ৭ মার্চ আরো এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাঙালির স্বাধীনতার মাস মার্চকেই দেশের আধা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় দলগুলো বেছে নিয়েছে স্বাধীনতার সপক্ষের শিবিরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য। তাদের লক্ষ্য কেবল '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করা নয়; ক্ষমতা থেকে এই বিচারের উদ্যোক্তা দলটিকেও উচ্ছেদ করা এবং তা সফল হলে বাংলাদেশে যে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে, তা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্রের খোলসে আধা তালেবানি শাসনব্যবস্থা। এই ষড়যন্ত্র রোখার জন্য এবারের ৭ মার্চ যতটা গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পালন করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সেই উদ্যোগ নিতে পেরেছে কি? তাদের সামনে আসদাহা সাপের মতো বিরাট কালো মুখ ব্যাদন করে আছে ১২ মার্চের বিএনপি ঘোষিত ঢাকা অবরোধের ডাক।
৭ মার্চকে উপেক্ষা ও অতিক্রম করে ১২ মার্চের এই ডাক দেওয়ার সাহস ও শক্তি বিএনপি ও জামায়াত কোথা থেকে পায়? আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতারা এই প্রশ্নটি ভেবে দেখেছেন কি? আওয়ামী লীগ দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারেনি এ কথা সত্য। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের মতো দুঃশাসন উপহার দেয়নি। এই কথাটি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং নিজেদেরও স্মরণ করা মহাজোটের নেতাদের উচিত। আওয়ামী লীগ নিজেদের দোষে দেশ শাসনে যতটা ব্যর্থ হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ ব্যর্থতার দোষ তার মাথায় চাপিয়ে তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রচার প্রপাগান্ডা চলছে। এই প্রপাগান্ডার জোয়ারে যদি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে ক্ষতি হবে কি আওয়ামী লীগের একার, না সারা দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির? দেশে আফগানিস্তানের মতো যে বাচ্চা-ই-সাক্কোর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যে উন্মত্ত প্রতিশোধের রাজনীতি শুরু হবে, তার কোপানলে কি শুধু আওয়ামী লীগই পুড়বে, না সারা দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি পুড়বে? আওয়ামী লীগের নেতারাও কি দেশের এই ভয়াবহ বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে সচেতন নন? না, তাঁরা ভাবছেন, ক্ষমতায় তাঁরা চিরস্থায়ী হয়েছেন।
'৭১-এর ৭ মার্চকে এবার তার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বে ফিরিয়ে আনা এবং প্রতিরোধের দুর্গ হিসেবে খাড়া করা ছিল এই দিবস পালনে উদ্যোক্তাদের কর্তব্য। তাঁরা সেই কর্তব্য পালন সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হয় না। একাত্তরের ৭ মার্চ ছিল বহিরাগত হানাদারদের হামলা প্রতিরোধের দুর্গ। এবারের দুর্গ গড়ে তোলা উচিত ছিল, সেই হানাদারদের দেশি অনুচরদের আরো বড় হামলা থেকে দেশের স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আওয়ামী লীগ যদি সেই দায়িত্ব পালনে উদাসীন থাকে এবং মহাজোটের নেতারা অভিমান করে এই প্রতিরোধের দুর্গ গড়ার কাজে অনাগ্রহী থাকেন, তাহলে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি মহাদুর্যোগ ঠেকানো সম্ভব হবে না। এবারের ৭ মার্চ এই সত্যটির দিকে সবার চোখ খুলে দিক।
লন্ডন ৬ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.