গণমাধ্যম-তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা... by আসিফ কবীর

১৯৮৪ সালে চার বছর বয়সে আমার মা মহাকাল ও মৃত্তিকার অংশ হয়ে যান। মায়ের অকালমৃতু্যর ২০ বছর পর ২০০৪ সালে বাবা ঘাতকের অতর্কিত হামলায় প্রাণ হারান। তখন বয়স সাড়ে ২৪ বছর। সেটিও অভিভাবকহীনভাবে চলার বয়স নয়। আমার শিক্ষাজীবন তখনো অসম্পূর্ণ।


পরিবার-বৈষয়িক দায়িত্ব নিতে প্রস্তুতও ছিলাম না। পিতার হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা, মধ্যবিত্ত জীবনের অনুষঙ্গ মৃতু্য-পরবর্তী আত্মীয়দের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা∏কিছুদিন পর থেকে বিরোধ, সম্পত্তি রক্ষার নিরন্তর চষ্টো, নিরাপত্তাহীনতা, হত্যায় জড়িতদের গ্রপ্তোর-বিচার, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আমরা। এর মধ্যেই টিকে থাকা ও ভালো করার সতত সংগ্রাম। সেই কথাগুলো মাহির সরওয়ার মেঘকে দেখার পর থেকে মনে পড়ছে।
মা-বাবা ছাড়া অপরিণত সন্তান যে কতটা অরক্ষিত, তা আমাদের জীবন দিয়ে জানা। সময় সময় প্রিয় সন্তানকে আত্মীয়-পরিজন থেকেও আগলে রাখতে হয় বাবা-মাকে। বাইরের দুনিয়ার হানাহানি, আঘাত, অঁাচড় থেকে তো বটেই। জীবনের এই অরক্ষিতাবস্থা, অনিশ্চয়তা ও শূন্যতাবোধ মানুষ মাত্রেরই মানস গঠন ব্যাহত করে। ব্যক্তিত্বের নিয়মিত বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। আবার সাবালকত্ব বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ, যা ব্যক্তিকে সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান করে তোলে। নিজের পর্যবেক্ষণ ও জীবনসংগ্রাম থেকে শাণিত প্রায়োগিক জ্ঞান ও প্রখর বাস্তব বোধ তৈরি হয়ে যায়।
মেঘকে দেখে ১৯৮৪ সাল, ওই সময়ের খণ্ড খণ্ড আবছা স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তখন গরমের সময়, ঝড়বৃষ্টিও হয়। মানুষ আমাকে দেখে যায়, মা-মরা ছেলে বলে সহানুভূতিপ্রবণ হয়। আমি সে সময় দিনমান কবর তৈরির খেলা খেলি। ছোট ছোট গর্ত করে যা পাই সেটিই মাটিচাপা দিয়ে কবর বানাই। কাঠি পুঁতে পুঁতে বেড়া তৈরি করি। বড়রা কেউ কেউ নিজেকে ও বাড়ির চত্বর নোংরা করায় রাগও হয়। কেউ বোঝে না কেন এ খেলায় আমার এত ঝঁোক, এর ধারণাও বা পেয়েছি কোত্থেকে। আমারও বোঝার কথা নয় বড়দের রাগারাগি অসংগত কিছু না। আজ এত বছর পর মেঘকে দেখে সব মনে পড়ে যায়। যে স্মৃতিগুলো আমার সাড়ে পঁাচ বছরের সন্তানের চার বছর হওয়ার আগে দিয়ে বারবার রোমন্থন করায় সজীব আছে। শহীদ মেজর তানভীরের পিতৃহারা সন্তানদ্বয়ের প্রসঙ্গে একইভাবে স্মৃতিকাতর হওয়ায় অনবরত অনুশীলনে অবিকল ধরে রাখা গেছে।...অভিন্ন বাস্তবতা পেরোনোয় প্রজন্ম প্রজন্মান্তরের এ এক অদ্ভুত নৈকট্য। একে আমরা অন্যের মাঝে আমাদের বিয়োগান্ত ঘটনা আবিষ্কার করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার মায়ের এমএ ক্লাসের পাঠ্য ও সহপাঠ্য বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছিলাম। বইগুলো পাতায় পাতায় দাগ দেওয়া, ওপর-নিচের ফঁাকা অংশে টপনোট ফুটনোট লেখা। অধীত বিষয়ের এ ব্যাপ্তি দেখে বুকটা হু হু করল। তঁার স্বল্পায়ু জীবন না হলে প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান দিয়ে আমার জন্য যে অবদান রাখতে পারতেন, তার শূন্যতা আরও বেশি অনুভব করলাম। বাবা-মা থাকলে মেঘ বা তার মতোই নাম না-জানা অন্য যারা যে যত্ন ও মনোযোগ পেয়ে বড় হতো, আংশিক হলেও সেই দায়িত্ব নিকটজনেরা পালন করবেন বলেই আশা করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তিনি মেঘের একজন অভিভাবক হয়ে থাকবেন। সরকারে বা বাইরে যেকোনো অবস্থায়ই ওর প্রতিপালনের দায়িত্ব রক্ষা করবেন। ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিদুর্ঘটনায় (৩ মে ২০১০) সবহারা তিন মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে এখনো আন্তরিকভাবে পালন করছেন। অনুরূপভাবে আমার পিতার হত্যার ঘটনায় খুলনায় ছুটে গিয়ে আমাদের সঙ্গে সমব্যথী হয়েছিলেন। তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা। তঁার সহমর্মী উপস্থিতি আমাদের শোকসহষ্ঞিু করেছিল। অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, শেখ হাসিনা পাশে থাকায় মেঘের ভারাক্রান্ত আগামীর অতিক্রমণ অনেকটাই সহজ হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও স্বজন হারানোর সতত স্মৃতি তঁাকে এমন সম-অনুভূতির গুণান্বিত করেছে।
পিতামাতার প্রাণ সংহার ঘটনার তিন দিন পর মেঘকে দেখি। এ সময় কেউ একজন বলল, মেঘ, তোমার একটা ছবি তুলি। ওমনি দঁাড়িয়ে আঙুলের চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে পোজ দিল। ছবি তোলা হয়ে গেল। বোঝার ক্ষমতা পূর্ণতা না পাওয়ায় সে এমন প্রতিদিনের উৎফুল্ল আচরণ করেছে বুঝে চোখে পানি এল। আফসোসও হলো শিশুরা যে রকম নিষ্পাপ ও নির্ভাবনা থাকতে চায়, আমাদের যাপিত জীবন কেন অমন মোলায়েম হয় না। কিন্তু চিরকাল মেঘ অবুঝ থাকবে না। সে ক্রমেই বড় হবে এবং বুঝতে শিখবে। তখন জহির রায়হানের উপন্যাসের নায়কদের মতো আঙুলের চিরুনি বুলিয়ে কেবল চুল ঠিক করবে না, জহির রায়হানের মতো অনুসন্ধিৎসু হবে। পুরোনো পত্রিকা ও ক্লিপে হারানো মা-বাবাকে খঁুজে ফিরবে।
সেই অনাগত ভবিষ্যতে মেঘের কাছে আমাদের জবাবদিহির দায় সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। বড় হয়ে সে যখন ২০১২ সালের সাংবাদিকতাকে দেখবে, তা যেন বস্তুনিষ্ঠতায় উত্তীর্ণ হয়, প্রত্যেকের সে চষ্টো থাকতে হবে। গণমাধ্যমের বহুত্ব ও আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা লাভের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার বিষয়টি মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। যেকোনো সংবাদের পরিবেশনায় কঠোর বস্তুনিষ্ঠতা কাম্য।
আসিফ কবীর: ২০০৪ সালে খুলনায় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালুর জ্যেষ্ঠ পুত্র।

No comments

Powered by Blogger.