৩৪ প্রকল্প, ২৩টির কাজ শুরু হয়নি by আনোয়ার হোসেন

রেলওয়ের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া ৩৪ প্রকল্পের মধ্যে ২৩টির বাস্তব কাজ শুরুই হয়নি। যে ১২টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, সেগুলো তুলনামূলক ছোট প্রকল্প। সময় শেষ হয়ে এলেও রেললাইন ও ইঞ্জিন-কোচ মেরামতসংক্রান্ত এসব প্রকল্পের কাজও দুই থেকে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত শেষ হয়েছে।


কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্তত তিনটি কারণে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক. অর্থস্বল্পতা বা পুরো অর্থের সংস্থান না করে ঠিকাদার নিয়োগ; দুই. একই কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া; তিন. একই ঠিকাদার একাধিক প্রকল্পে কাজ পাওয়া।
প্রকল্প অনুমোদনের নথি থেকে জানা যায়, ৩৪ প্রকল্পের মধ্যে নয়টি অনুমোদন হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের মধ্যে। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নেওয়া হয় আরও ১৮টি প্রকল্প। ২০১১ সালে অনুমোদন দেওয়া হয় সাতটি প্রকল্প। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সবগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কথা।
এর মধ্যে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান ছাড়াই তিন বছরে ১২টি প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৬টি প্রকল্পের দরপত্রপ্রক্রিয়া মূল্যায়ন চলছে। বাকি ছয়টি প্রকল্পের কোনো কার্যক্রম নেই।
রেলওয়ের গত জানুয়ারি মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাজ শুরু হওয়া প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি তিন বছরে দুই থেকে ৫৮ শতাংশ, যদিও এগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে।
বছরের বাজেট অনুযায়ী, রেলওয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর জন্য চলতি অর্থবছরে চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে, জাপান ঋণ মওকুফ তহবিল থেকে ৬২১ কোটি এবং প্রকল্প সহায়তা থেকে এক হাজার ৬১২ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রাজস্ব খাত থেকে মাত্র ৪৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। জাপানি ঋণ মওকুফ তহবিলের বরাদ্দ পুরোটাই ছিল। আর প্রকল্প সহায়তা পাওয়া যায় চাহিদা থেকে ৪২৫ কোটি টাকা কম।
নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি প্রকল্পে বিদেশি ঋণসহায়তার সঙ্গে রাজস্ব খাতের কিছু বরাদ্দ রাখতে হয়। বিদেশি সহায়তার সঙ্গে ও হারাহারিভাবে দেশীয় অংশের জোগান না থাকলে বিদেশি অর্থও খরচ করা যায় না। এ জন্য রাজস্ব খাতের প্রকল্পের পাশাপাশি বিদেশি সাহায্যপুষ্ট অনেক প্রকল্পের টাকা থাকা সত্ত্বেও খরচ করা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, মাত্র তিনজন কর্মকর্তা মোট ১৮টি প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন। প্রধান প্রকৌশলী কাজী রফিকুল আলম (পশ্চিম) পাঁচটি, প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পশ্চিম) আক্তারুজ্জামান হায়দার পাঁচটি, প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প) চারটি, প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) চারটি করে প্রকল্পের দায়িত্বে। এসব উচ্চপদের এ কর্মকর্তারা প্রকল্পের বাইরে রেলের দৈনন্দিন কাজও করেন। রেলওয়ে-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এক ব্যক্তির একাধিক বড় দায়িত্বে থাকাকেও সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করলেন।
তৃতীয়ত, রেলের যেসব প্রকল্পে এরই মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে, এর ৮০ শতাংশই পেয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন, ম্যাক্স অটোমোবাইলস ও এসিই কনসালট্যান্ট নামের তিনটি সংগঠন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো একা, কখনো যৌথভাবে, আবার কখনো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে রেলের কাজ করছে। মাত্র কজন লোকের হাতে এতগুলো প্রকল্প থাকায় তা সময়মতো কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করছে।
সবশেষে, সময়মতো প্রকল্প শেষ না হলে পুনর্মূল্যায়ন করে আবার প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়; বাড়ে খরচ। টঙ্গী-ভৈরববাজার পর্যন্ত আরেকটি রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের কাজ সময়মতো শুরু না হওয়ায় এক হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পটি ২০০৬ সালে নেওয়া হয়েছিল। এ সরকারের আমলে ব্যয় বৃদ্ধি অনুমোদন করা হয়। লাভবান হন ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা; কিন্তু সময়মতো সেবা পান না যাত্রীরা। তাঁদের ভোগান্তি বাড়ে। বাড়ে রেলের ক্ষতি। রুগ্ণ হয় যোগাযোগব্যবস্থা।
নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতীয় ঋণে যে ১২টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হবে। তবে তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে এসব প্রকল্প এই সরকারের বাকি সময়ে শেষ করা কঠিন হবে। তাই ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের মধ্য সরাসরি কোনো সমঝোতায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবেন তিনি।
আখাউড়া থেকে লাকসাম নতুন রেললাইন নির্মাণ ও সৈয়দপুর ওয়ার্কশপ আধুনিকায়নে ভারতীয়দের এগিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। মন্ত্রী কমলাপুর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমন একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হচ্ছে। এটি হলে তা হবে রেলমন্ত্রীর প্রথম প্রকল্প। এ ছাড়া রেলমন্ত্রী সারা দেশে রেলের জায়গায় পাঁচ তারকা হোটেল, শপিং মল, মেডিকেল কলেজ নির্মাণসহ ছয়টি প্রকল্প সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে রেলভবনে মন্ত্রীর দপ্তরে গেলে প্রথমে তিনি কিছু বলতে চাননি। এরপর স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনার একটি তালিকা দেন। তাতে জানুয়ারি থেকে ১৮ মাসে বাস্তবায়ন করা হবে এমন ৩২টি কাজের উল্লেখ আছে। এর মধ্যে রয়েছে: নতুন ট্রেন চালু, আন্তনগর ট্রেনের সময়সূচি উন্নীতকরণ, আন্তনগর ট্রেনের কোচের ঘাটতি পূরণ, রাজশাহী-রোহনপুর, গৌরীপুর-জারিয়াজাঞ্জাইল, শ্যামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ, লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলপথ পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন করা।
বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া বাকি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। মন্ত্রীর উপস্থিতিতে রেলের মহাপরিচালক জানান, বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ঠিকাদারদের সঙ্গে ৫৩টি চুক্তিপত্র হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.