৭ মার্চের সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-ইতিহাস আছে, উদ্যান নেই by আশীষ-উর-রহমান

কিছু গাছপালা টিকে থাকলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে এখন আর ঠিক উদ্যান বলা যায় না। এটি এখন আবর্জনা ও বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত প্রদর্শনী। কী নেই বাঙালির সংগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম স্মৃতিময় এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে? অসংখ্য চটপটি-ফুচকার দোকান, বিস্তর অসমাপ্ত স্থাপনার শ্রীহীন কংক্রিটের কাঠামো, মাঠজুড়ে অজস্র


জঞ্জালের স্তূপ, ভবঘুরেদের ঝুপড়ি, দূষিত পানির আধার, ক্রিকেটের ক্রিজ, এক কোনায় চারুশিল্প বিক্রির উন্মুক্ত বাজার থেকে ক্রমপ্রসারমাণ ধর্মীয় স্থাপনা—বাদ নেই কিছুই। বিপরীতধর্মী বিষয়বস্তুর বিপুল বিশৃঙ্খল সমারোহে হারিয়ে গেছে উদ্যান নামের সবুজের সমারোহ।
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান: একটি ডিজিটাল ব্যানারে কবি নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতাটিও দেখা গেল উদ্যানে। হয়তো কোনো এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেটি তৈরি করা হয়েছিল। এখন পড়ে আছে একটি অর্ধসমাপ্ত কংক্রিটের কাঠামোর সঙ্গে। এই মাঠে যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমরা পেলাম’ কবিতাটি সেই বিষয়ে। ওই কবিতার একাংশে কবি বর্তমানে উদ্যানের যে হাল তুলে ধরেছিলেন, ‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ/ বিকালের বিরুদ্ধে বিকেল/ উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান’—বড় নির্মম হয়ে তা এখন প্রতিভাত হয় এখানে এলে।
উদ্যানের উত্তর প্রান্তের মাঝবরাবর শুরু হয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ প্রকল্পের স্থাপনা। প্রথমেই শিখা চিরন্তন। এরপর ঢালাই করা ‘অ্যাপ্রোচ প্লাজা’ চলে গেছে দক্ষিণে প্রধান স্থাপনার দিকে। এর দুটি অংশ—উত্তরের অংশের সামনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্থান। সেখানে ত্রিভুজাকৃতির একটি ১২ ফুট উঁচু ধাতব স্তম্ভ। এর এক পাশে বাংলায় লেখা তাঁর বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠের ঘোষণা: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অন্য পাশে তা লেখা ইংরেজিতে। এরপর একটি বৃত্তাকার ফোয়ারা। পূর্ব দিকের দেয়ালে মাটির ফলকে ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য উৎকীর্ণ। উন্মুক্ত মঞ্চের চারপাশ ঘিরে জলাধার। এখন তাতে পানি নেই। কিশোর-তরুণেরা মহানন্দে ক্রিকেটের চর্চায় রত। এর দক্ষিণে সেই কাচনির্মিত স্বাধীনতাস্তম্ভের নির্ধারিত স্থান। প্লাজা চত্বরের তলদেশে রয়েছে ভূগর্ভস্থ জাদুঘর।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরের ঘটনার স্মৃতিবাহী উদ্যানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এই স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’ নামে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালে। বরাদ্দ ছিল ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগ সূত্র জানায়, মাঝখানে সরকার বদল হলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জুলাই থেকে। বরাদ্দ ১৮১ কোটি টাকা। কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময় ২০১২ সালের ৩০ জুন। তবে এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত শিখা চিরন্তন, অ্যাপ্রোচ ও মূল প্লাজা, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, জলাধার, ভাষণ স্থানের স্তম্ভ ও কিছু পায়ে চলার পথ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন মূলত বাকি কাচের স্তম্ভ নির্মাণ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান এনডিই ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক মার্কিন প্রতিষ্ঠান নোভাম দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ করছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কনকর্ড।
বিশিষ্ট স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের সঙ্গে আমরা ছিলাম। তবে তাদের অপরিপক্বতা ও দক্ষ জনবলের অভাবে এই প্রকল্প যথাসময়ে সম্পন্ন হয়নি, দীর্ঘসূত্রতায় আটকে গেছে। সরকারের সদিচ্ছারও অভাব আছে বলে মনে হয়েছে। আমরা এই কমিটি থেকে সরে এসেছি। পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে উদ্যানটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতো। কিন্তু এখন বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। খুব সহজে এই উদ্যানের হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা যাবে বলে মনে হয় না।’
জটিল স্তম্ভ: প্রস্তাবিত স্বচ্ছ কাচের স্তম্ভটি হবে ১৫০ ফুট উঁচু। বর্গাকৃতি। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৬ ফুট। একটির ওপর একটি ১৯ মিলিমিটার পুরু কাচের ফলক সাজিয়ে এটি নির্মাণ করা হবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নকশা নির্বাচন করা হয়। এটি করেছেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব ও মেরিনা তাবাসসুম। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে স্তম্ভটি তৈরি করা নিয়ে। কাচের পাত সাধারণত খাড়া করে জানালা-দরজা বা অন্য সব কাজে ব্যবহার করা হয়। পরিভাষায় বলে ‘ক্লেন্ডিংগ্লাস’। কিন্তু স্তম্ভটি করা হবে একটির ওপর আরেকটি চাপিয়ে। এই পদ্ধতির নাম ‘স্টেকগ্লাস’। পৃথিবীর কোথাও এভাবে কাচের ফলক ব্যবহার করে এমন স্তম্ভ নির্মাণের নজির নেই। এত সব ফলক কেমন করে আটকে রাখা যাবে, অথচ আটকে রাখার কাঠামো যেন প্রকটভাবে দেখাও না যায়, এমন একটা উপায় করতেই বহু সময় লেগেছে। শুধু এই উপায় বের করে স্তম্ভের নমুনা জমা দেওয়ার জন্যও আলাদা করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অবশেষে এই জটিল স্তম্ভ নির্মাণের একটি পদ্ধতি পাওয়া গেছে। সেই নমুনা পাঠানো হয়েছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে, তা পরীক্ষা করতে। বুয়েট ৪৫ দিন সময় চেয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে স্বচ্ছ কাচের স্বাধীনতাস্তম্ভ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যাবে বিশ্বের প্রথম ‘স্টেকগ্লাস’ স্তম্ভ হিসেবে।
অতঃপর: স্তম্ভ নির্মিত হলেই যে বর্তমানের কুৎসিত এই স্থানের চেহারা বদলে যাবে, তা নয়। অতঃপর এর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে তৃতীয় দফার কাজ করতে হবে। গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তৃতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। অনুমোদন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পর্যায়ক্রমে হবে। এই পর্বে শিশুপার্ক ও পুলিশ ফাঁড়িকে উদ্যানের সঙ্গে একীভূত করা হবে। উচ্চ আদালত এই দুটি স্থাপনা স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন।
উদ্যান থেকে সব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলে শিশুপার্ক অংশে একটি থিমপার্ক করা হবে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে গাছ লাগানো হয়েছিল বনায়নের কথা বিবেচনা করে, উদ্যানের বিবেচনায় নয়। এখানে যেসব গাছ আছে, তার বেশির ভাগই বিদেশি প্রজাতির। ফুলে-ফলে আমাদের ষড়্ঋতুর প্রতিনিধিত্ব করে এমন দেশি প্রজাতির গাছ লাগানো হবে। নান্দনিক ভূদৃশ্য করা হবে এই শহর আর এই স্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্থাপনার সঙ্গে মানানসই করে। তবে এ সবই এখনো ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলে যে কারোরই এখন আলীবাবা নাটকের মর্জিনার উক্তিটিই মনে পড়বে। মাঠজুড়ে চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, ইট, সুরকি, চটপটির দোকানের ভাঙা বেঞ্চ-চেয়ার, ব্যানার-ফেস্টুনের ছেঁড়াফাটা টুকরো, ইট, খোয়া, বালুসহ ছড়ানো-ছিটানো নির্মাণসামগ্রী আর রাশি রাশি শুকনা পাতায় ভরা। পূর্ব ও উত্তরাংশে নির্মাণকর্মীদের টিনের ঘর। দক্ষিণ-পশ্চিমে ভবঘুরেদের ঝুপড়ি। তারা গাছের শাখায় দড়ি টানিয়ে রোদে শুকোতে দিয়েছে পোশাক-আশাক। রান্নাবান্না চলছে। টিএসসির দিকটা যেন চটপটির ঠেলাগাড়ির গ্যারেজ। সারি সারি চটপটির স্টল কালীমন্দিরের পাশে। পূর্ব-দক্ষিণে ক্রিকেট মাঠ। পশ্চিমে বাংলা একাডেমী বরাবর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও উন্মুক্ত থিয়েটার মঞ্চ। উত্তর-পশ্চিমে ছবির হাট। এর মধ্যেই একটু নিভৃতির সন্ধানে হাত ধরাধরি করে আসছেন তরুণ যুগল। কোথাও কোথাও ‘বড় তামাক’সেবীদের মজমা। রাত একটু গভীর হলেই উদ্যানে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। নিচে হতশ্রী দশা, ওপরে গাছের শাখায় নববসন্তের নতুন পাতার উন্মেষ। কোথাও কোথাও একটু রক্তিম ছোপ অশোকগুচ্ছে।
নতুন করে পুরোনো মন্দির: উদ্যানের দক্ষিণে শ্রীশ্রীরমনা কালীমন্দির ২ একর ২২ শতাংশ এলাকা নিয়ে। এখানে এখন কালীমন্দিরের পাশে দুর্গামন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, মা আনন্দময়ী আশ্রম ও হরিচাঁদ ঠাকুর মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। সামনে মজা পুকুর। সেখানে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব স্থাপনা অবৈধ। রমনায় একটি ছোট্ট কালীমন্দির ছিল। মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দয়াময় বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এই কালীমন্দির ৪০০ বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ সিএস অনুসারে মন্দিরের ২ একর ২২ শতাংশ জায়গা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ কাজী আজিজুল মওলা বলেন, ‘শহরের ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু যে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, তা উদ্যানের সঙ্গে কতটা মানানসই, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। সংরক্ষণ করা মানেই স্তম্ভ নির্মাণ, এ ধারণা সঠিক নয়। এখানে নিসর্গ ও পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে ল্যান্ডস্কেপ করা যেত। এই উদ্যানটিরও দুই-তৃতীয়াংশ চলে যাচ্ছে এই স্থাপনা ও মন্দিরের আওতায়। নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থাপনা নির্মাণ করার উদ্যোগ নিলে ভালো হতো।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ভদ্রলোক এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে পারেন না। জায়গাটি অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া। মোগলেরা রমনা উদ্যান করেছিল। ব্রিটিশ আমলে হলো রেসকোর্স। ইতিহাসের প্রয়োজনে ‘রমনা’ নামটিই থাকা প্রয়োজন। কারণ, বঙ্গবন্ধু কোথায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বা হানাদাররা কোথায় আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বললে তা বোঝা যায় না। বন্ধনীর ভেতরে লিখতে হয় ‘তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দান’। উদ্যানটিকে রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিভ্রান্তি ও জটিলতারও অবসান হওয়া দরকার।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি আহসানুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থানগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। নির্মাণকাজ শেষ হলে উদ্যানটিকে বিশেষ সংরক্ষিত (কেপিআই) এলাকা হিসেবে পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.