ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু : একটি অনন্য স্মারক by নাসির আহমেদ

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ, বাংলাদেশ নামের জাতি-রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে বহু গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলনসহ নানা প্রকাশনায় তার শ্রেষ্ঠত্বের দ্যুতি প্রতিফলিত। একটি নাম কী অসীম শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে, তা কেবল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।


প্রয়াত প্রবীণ কবি আবদুস সাত্তারের কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি নাম প্রসঙ্গেই এ মুহূর্তে স্মরণে আসে :
একটি অমিয় নাম, কোটি কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিদিন সকাল বিকাল/ নক্ষত্রের মতো জ্বলে, জ্বলজ্বলে গগনের কোলে মহাকাল/ সে নামে মানুষ জাগে, পাখি জাগে, ফুল তার বিলায় সুবাস/ সে নামে নদীরা জাগে, নির্ঝরের স্বপ্ন ভাঙে, কবিতায় ছন্দ অনুপ্রাস/ সে নামে আহুতি দেয় বাংলার সন্তানেরা টগবগে লক্ষ তাজা প্রাণ/ আমার শাশ্বত গর্ব সেই নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুচ্ছে হয়তো আবেগবিহ্বলতা আছে, কিন্তু সে আবেগ বাস্তববর্জিত নয়। 'বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা' এই তিনটি শব্দ তো আজও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এবং এ দেশের স্বাধীনতা কল্পনাও করা যায় না। একটি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়ে অটল সাহস আর গভীর দেশপ্রেমের শক্তিতে কীভাবে অতি তরুণ বয়সেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল তথা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতির গুরুদায়িত্ব অর্জন করেছিলেন, তা তার জীবন পর্যালোচনা করে সবিস্ময়ে ইতিহাসের সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। দেশ এবং দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসলেই এমন বিরল সাফল্য অর্জন সম্ভব। পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ অনেকেই নেতা ছিলেন, কিন্তু তার মতো এমন সাহসী, এমন অকপট অঙ্গীকারে দেশ এবং দেশের মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর কেউ ভালোবাসতে পারেননি বলেই বঙ্গবন্ধু গণমানুষের অতুলনীয় ভালোবাসায় শীর্ষ জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝেছিলেন, পূর্ববাংলার মানুষ ব্রিটিশ কলোনি থেকে আরেক কলোনিতে বন্দি হলো। সেই থেকে ধাপে ধাপে নানা কৌশলে সংগ্রামের একেকটি সিঁড়ি পেরিয়ে গণতন্ত্রবঞ্চিত এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে আদায় করেছিলেন মাথাপিছু এক ভোটের সাধারণ নির্বাচন। ১৯৭০-এর সেই নির্বাচনের বিপুল গণরায়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ চলে যায় মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বাস্তবতায়। বঙ্গবন্ধু সুকৌশলে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অসীম ধৈর্য, যা হতে পারত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বিশ্ববাসীর কাছে তাকে পরিণত করলেন একটি মহান মুক্তিযুদ্ধে। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে অনিবার্য করে তুললেন মুক্তির সংগ্রামে প্রস্তুতি এবং সতর্কতার বিষয়টি। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জননেতা এমন ভাষণের নজির স্থাপন করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এই যে মূল্যায়ন_ এই মূল্যায়ন যদি 'ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু' শীর্ষক অনন্য এই সংকলন গ্রন্থের সারকথা বলে তুলে ধরা হয়, তা হলেই এ সংকলনের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন পাঠকরা। বঙ্গবন্ধুর ৩৬তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই সংকলনটি প্রকাশ করেছে গত আগস্ট (২০১১) মাসে। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নূহ-উল-আলম লেনিন এই স্মারক সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক ও প্রকাশক। সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ওবায়দুল কাদের এমপি, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, এইচটি ইমাম, আফজাল হোসেন, অসীম কুমার উকিল, শেখর দত্ত, সুবাস সিংহ রায়, তারিক সুজাত ও শাহরিয়ার আলম এমপি।
এই স্মারকগ্রন্থে যাদের লেখা সংকলিত হয়েছে তাদের মধ্যে দেশের বরেণ্য লেখক, কবি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের প্রতিনিধি রয়েছেন। লিখেছেন ইতিহাসবিদ, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদরাও। বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার লেখা সংকলনের অন্যতম আকর্ষণ। শুধু পিতৃমাতৃহারা সন্তানের বেদনাদীর্ণ স্মৃতিমাত্র নয়, প্রাণপ্রিয় তিন ভাইসহ সকল স্বজন হারানোর অসীম বেদনা ছাপিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছেন একজন মমতাময় পিতা ও সফল রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ হাসিনার লেখার শিরোনাম_ 'আমাদের ছোট রাসেল সোনা'। একটি ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর মাত্র ১১-১২ বছরের স্বল্প পরিসর জীবনের যে মধুর স্মৃতি, যে করুণ স্মৃতি তা পাঠকের চোখ আর্দ্র করে, ওই স্মৃতির মধ্যেই বঙ্গবন্ধুসহ গোটা পরিবারের চিত্র উদ্ভাসিত। বেশি করে মূর্ত বঙ্গবন্ধু, যার স্নেহসানি্নধ্য কমই পেয়েছেন সন্তানরা, বারবার কারাগারের দেয়ালে আটকে গিয়েছিল সব। শেখ রেহানার লেখার শিরোনাম_ '১৫ আগস্ট : শোকাহত হৃদয়ের ভাব'। লেখাটি পড়ে একজন মমতাময় পিতার ছবিটি যেমন স্পষ্ট, তেমনই স্পষ্ট সেই শোকাবহবিধুর ইতিহাস।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'ইন্দ্রপাত' লেখাটি পড়তে অনুরোধ করব সবাইকে। কী অসাধারণ মূল্যায়ন হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর! তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার অসাধারণ স্মৃতিসহ অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায় তার লেখায়। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের লেখায় বঙ্গবন্ধু যে একাই ছিলেন এ জাতির সমস্ত স্বপ্নের প্রতীক সে কথাটা স্পষ্টভাবেই বলেছেন। ড. আনিসুজ্জামান ইতিহাসের আলোকে প্রমাণ করেছেন কেন বঙ্গবন্ধু সবাইকে ছাপিয়ে এমন উন্নত শির বীরত্বের গৌরবে ভাস্বর। প্রায় প্রতিটি লেখা নানা কারণে আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু স্বল্প পরিসরে তা অসম্ভব। শুধু লেখক তালিকার কয়েকটি নাম উল্লেখ সম্ভব। গদ্য লিখেছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, অজয় রায়, আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আলী যাকের, আলমগীর সাত্তার, আতিউর রহমান, এইচটি ইমাম, খান সারওয়ার মুরশিদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নীলিমা ইব্রাহিম, দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, নুরুল ইসলাম নাহিদ, নির্মল সেন, নূহ-উল-আলম লেনিন, পংকজ ভট্টাচার্য, ফারুক চৌধুরী, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, মফিদুল হক, মশিউর রহমান, মাহবুব রেজা, মোঃ মাহবুবুর রহমান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, র আ ম উবায়েদুল মোকতাদির চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, রেহমান সোবহান, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, শামসুজ্জামান খান, শাহীন রেজা নূর, শেখর দত্ত, শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সরদার ফজলুল করিম, সালাহউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুন-অর-রশীদ, হাসানুল হক ইনু, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। কবিতায় জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ প্রমুখ প্রয়াত কবির কবিতার সঙ্গে রয়েছে বর্তমান কবিদেরও কবিতা। শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব কবির কবিতা সংকলিত হয়েছে এতে।
এই স্মারক সংকলনের অঙ্গসজ্জাকে আকর্ষণীয় করেছে দেশবরেণ্য শিল্পীদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর একাধিক দৃষ্টিনন্দন পোট্র্রেট। শিল্পীদের মধ্যে আছেন কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানসহ প্রবীণ-নবীন অনেকেই। আলোকচিত্র রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা পর্বের, যা বাড়িয়েছে বইটির আকর্ষণ। আলোকচিত্রীরা হলেন_ রশীদ তালুকদার, আফতাব আহমদ, মোহাম্মদ আলম, জহিরুল হক, লুৎফর রহমান ও পাভেল রহমান।
এক কথায় এ গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক অনন্য স্মারক।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.