গদ্যকার্টুন-বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো by আনিসুল হক

আমি মোটামুটি ২২ বছর ধরে গদ্যকার্টুন লিখছি। একই কথা প্রতিবছর লিখি। নতুন কোনো কিছুই ঘটে না এই দেশে। সেই সরকারি দল আর বিরোধী দল। সেই হানাহানি, প্রতিহিংসা। সেই সরকারি দলের লোকদের ক্ষমতার দম্ভ। সেই বিরোধী দলের ‘দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে’ বলে হুংকার।


সেই নির্বাচনের আগে গালভরা প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতায় বসেই সবকিছু বেমালুম ভুলে যাওয়া। তাদের ভাব দেখে মনে হয়, প্রবাদই সত্য, মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো, বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো।
ঈদের ছবিও প্রতিবছর একই। রমজান মানে দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। বাসে-ট্রেনে ভিড়। নীরব চাঁদাবাজি। ঈদের আগের পত্রিকায় ট্রেনের ছাদে আর লঞ্চের ছাদে মানুষের ভিড়ের ছবি থাকবেই। লঞ্চের ছবিটা বুড়িগঙ্গার ওপরের কোনো সেতু থেকে তোলা হবে। ট্রেনের ছবিটা টঙ্গীর কাছ থেকে তুললে ভালো আসবে। ঈদের সময় ঢাকার ফাঁকা হয়ে যাওয়া। ঈদের আগের খবর, ছুটির ফাঁদে বাংলাদেশ। ঈদের পরের ছবি হলো, সরকারি অফিসের সারি সারি ফাঁকা টেবিল-চেয়ার। এর মধ্যে অনিবার্য থাকবে কয়েকটা সড়ক দুর্ঘটনা।
তবে এবার ঈদে একটা নতুন ঘটনা আছে। এবার ঈদ নাকি জনপদে জনপদে অন্যবারের তুলনায় ভিন্ন রকমভাবে পালিত হচ্ছে। কারণ, কোনো মন্ত্রী-এমপি নাকি এই ঈদে এলাকায় যাচ্ছেন না। কারণ, তাঁদের মুখ দেখানোর জো নেই। এটা বিরাট খবর। তার মানে তাঁদের লজ্জা-শরম আছে।
ধন্যবাদ সৈয়দ আবুল হোসেন আর শাজাহান খানকে। তাঁরা এবার খবরে বৈচিত্র্য এনে দিয়েছেন। রমজান মাসে মহাসড়কে খানাখন্দক সৃষ্টি করার অপূর্ব সাফল্য এবার সংবাদমাধ্যমকে খবর পরিবেশনে ভিন্নতা দিয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
সরকার অবশ্য সমালোচনা পছন্দ করে না। কোনো সরকারই করে না। তারা মনে করে, সমালোচনা সংবাদমাধ্যম পরিকল্পিতভাবে করছে, এটা করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এবং এই সব সমালোচনার কোনো ভিত্তিই নেই। এটা যে শুধু আমাদের দেশে হয়, তা নয়, সব দেশেই হয়—কোনো দেশের সরকারই সংবাদমাধ্যমকে পছন্দ করে না।
ঈদের আগের গদ্যকার্টুনে কৌতুক পরিবেশন না করে এসব কী লিখছি? আমার কোনো নতুন কৌতুক মনে পড়ছে না। একটা পুরোনো কৌতুকই বলি। একটা বাঘ ঘুমিয়ে ছিল। একটা বাঁদর তাই না দেখে তার স্বভাবসুলভ বাঁদরামি শুরু করে দিল। সে ঘুমন্ত বাঘের পিঠে উঠে বাঘের দুই কান মলে দিতে লাগল। বনের সব পশুপাখি সে দৃশ্য দেখে হাসাহাসি করতে লাগল। বাঘের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ মেলে দেখে সবাই হাসছে। বাঁদর অমনি লাফিয়ে বাঘের পিঠ থেকে নেমে পালাতে লাগল। বাঘ তাকে ধরার জন্য পিছে পিছে ছুটতে লাগল।
বাঁদর বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে এল।
বাঘও লোকালয়ে এল তার পিছু পিছু। বাঁদর একটা সরকারি অফিসে ঢুকে পড়ল। দেখল, একটা অফিসারের টেবিল। কর্তা নেই। তাঁর চেয়ার ফাঁকা, চেয়ারে একটা কোট ঝুলছে, আর টেবিলে একটা পত্রিকা পড়ে আছে। বাঁদর চেয়ারে বসে পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। বাঘটাও ততক্ষণে এসে পড়েছে সেই কক্ষে। সে বলল, ‘স্যার, এই ঘরে কি কোনো বাঁদর ঢুকেছে?’
পত্রিকার আড়াল থেকে বাঁদর গলার স্বর মোটা করে বলল, ‘কোন বাঁদর? যে বাঁদর একটা বাঘের কান টেনে তার সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে?’
সর্বনাশ। এই খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে নাকি? বাঘ উল্টো দৌড় ধরে ফিরে এল তার বনে।
সংবাদপত্রে ছাপা হলে কোনো কাজ হয় না, তা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যমে মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কথা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে বলেই তড়িঘড়ি করে মহাসড়কগুলোয় মেরামতের কাজ ঈদের আগেই শুরু করা হয়েছে। তাতে যোগাযোগ পরিস্থিতি এক মাস আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে।
শুধু পুরোনো কৌতুক বললে আপনারা বলবেন, ঈদের আগে একটা নতুন কৌতুকও কি শোনানো যেত না। আচ্ছা, একেবারে ঝকঝকে তকতকে নতুন কৌতুক। একটা বাঘ যাচ্ছে পথ দিয়ে। দেখল, দুটো লোক পথের ধারে। একজন লোক পত্রিকা পড়ছে। আরেকজন লোক কম্পিউটারে লিখছে। বাঘটা যে লোকটা পত্রিকা পড়ছে, তাকে খেয়ে ফেলল। আর যে লোকটা লিখছে, তাকে কিছুই করল না।
কারণ কী? বাঘ বলল, ‘শোনেন নাই? রিডারস ডাইজেস্ট। পাঠককে খেলে হজম করা যায়। কিন্তু সাংবাদিক? বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা আর সাংবাদিক ছুঁলে... আপনি সব হজম করতে পারবেন, কিন্তু সাংবাদিক হজম করতে পারবেন না।’
এবার আরেকটা পুরোনো কৌতুক। এক প্লেন দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। সব যাত্রী, চালক, সেবক মারা গেছেন। শুধু একটা বাঁদর, যে ওই প্লেনে ছিল, বেঁচে আছে। তাকে মানুষের ভাষা শেখানো হলো। বাঁদর ইঙ্গিতে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। তদন্তকারী কর্তা বললেন, প্লেনটা যখন অ্যাক্সিডেন্ট করে তখন যাত্রীরা কী করছিল?
বাঁদর ইঙ্গিত করল, ঘুমোচ্ছিল।
‘বিমানসেবকেরা কী করছিলেন?’
বাঁদর ইঙ্গিত করল, ঘুমোচ্ছিল।
‘পাইলট কী করছিলেন?’
‘ঘুমোচ্ছিল।’
‘তাহলে তুই বাঁদর কী করছিলি?’
বাঁদর এবার ইঙ্গিত করল যেন সে বসছে ককপিটে এবং প্লেনটা চালাচ্ছে।
মানে বাঁদর প্লেন চালাচ্ছিল।
চালক ঘুমিয়ে পড়লে দুর্ঘটনা ঘটে।
অযোগ্য চালক প্লেন চালালেও দুর্ঘটনা ঘটে।
কবি নজরুল গেয়েছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। চালকদের জাগিয়ে তোলার কাজটা তরুণদেরই নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। কচি-কাঁচারা চিৎ কার করলে কানে তুলো গুঁজেও কোনো লাভ হবে না।
ঈদ মোবারক। সবার ঈদের দিন ভালো কাটুক। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বজনের সঙ্গে আনন্দে ঈদ করুন। যাঁরা বাড়ি গেছেন, তাঁরা নিরাপদে বাসায় ফিরে আসুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.