বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-একাত্তরের ৭ মার্চ ও বাংলার বিদ্রোহ by আবদুল মান্নান
১৯৭০ সালের অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনে এটি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে। তবে এটি সবার কল্পনারও বাইরে ছিল যে শেষতক তা ১৬৭টি আসনে গিয়ে ঠেকবে।
পাকিস্তানের সব গোয়েন্দা সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে এই ধারণা দিয়েছিল, আওয়ামী লীগ ৮০ থেকে ৯০টা আসনে জয়ী হবে আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৬০-৭০টির মতো আসন পাবে। সুতরাং শেখ মুজিবকে সরকার গঠন করতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে ভুট্টোর পিপলস পার্র্টির সমর্থন প্রয়োজন হবে। একটি কথা তখনো সত্য ছিল, এখনো সত্য , কোনো সরকার তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়লে বিপদ অনিবার্য। সত্তরের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে অনেক সামরিক ও বেসামরিক আমলা কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তঁাদের অনেকে সত্তরের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২৬ মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। মোটামুটি প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন তঁাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পরিষ্কার ছিল যে নির্বাচন দিলে শেখ মুজিব ও তঁার দল আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এর চেয়ে নানা অজুহাতে সত্তরের নির্বাচন দীর্ঘায়িত করে একসময় বানচাল করে দেওয়াটাই অনেক যুক্তিসংগত হতো। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক (এলএফও) নামের আরেকটি সামরিক ফরমান জারি করেন, যাতে তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান কী হবে তার একটা রূপরেখা দেন। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে সর্বাত্মক সহায়তা করেন তঁার মনি্ত্রসভার বাঙালি সদস্য এবং তঁার একান্ত আস্থাভাজন অধ্যাপক জি ডবি্লউ চেৌধুরী। অধ্যাপক চেৌধুরী একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিবের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সব সংসদীয় আসনের ৯৯ শতাংশে বিজয় লাভ করা। তিরি আরও লিখেছেন, তখন তঁাকে (শেখ মুজিব) স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রচষ্টোয় কে রুখবে? ইয়াহিয়া খানের এলএফওর অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে মওলানা ভাসানী ও মুজাফ&ফর আহমদের ন্যাপ অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও অনেকে এই প্রশ্ন রাখেন, এলএফওর অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে পরবর্তীকালে তো আর ছয়দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু তঁার সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন নির্বাচনে অংশ নিলে পরবর্তীকালে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দর-কষাকষিতে সুবিধা হবে। আসলে বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন আর সে জন্যই তিনি রাষ্ট্রনায়ক। বস্তুতপক্ষে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে তিনিই প্রথম এবং শেষ রাষ্ট্রনায়ক।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আর তাদের সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যাশা ও রিপোর্টকে ভুল প্রমাণ করে যখন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হলো তখন তা ছিল তাদের জন্য অনেকটা বজ্রাঘাতের মতো। ১৯৭০-এর আগস্ট মাসে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে (আনুমানিক পঁাচ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল) পূর্ববাংলায় সাধারণ নির্বাচন দুই কিসি্ততে হয়। প্রথমটি ৭ ডিসেম্বর এবং পরেরটি উপকূলীয় অঞ্চলে, ১৯৭১-এর ১৭ জানুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টি সিটের মধ্যে ভুট্টোর পিপিপি ৮৫টিতে জয়লাভ করে যার মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবগুলোই ছিল সন্ধিু ও পাঞ্জাবের। ২০ ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা করেন Èপুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে যেই বিজয়ী হোক না কেন কেন্দ্রে কোনো সরকারই পিপিপির সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া সফল হবে না কারণ পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সন্ধিু ও পাঞ্জাব এবং তা সম্পূর্ণভাবে আমার (ভুট্টোর) নিয়ন্ত্রণে।'
এতেই বোঝা যায় নির্বাচনের পরপরই ভুট্টো পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তথা বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুজিব তো আর ভুট্টোর মতো হঠকারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। তিনি আজীবন নিয়মতানি্ত্রক রাজনীতি করে এসেছেন। বললেন জাতীয় সংসদে আসুন। সেখানে একজনও যদি ন্যায্য কথা বলে তাও মানা হবে। বঙ্গবন্ধু দাবি করলেন যেহেতু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সেহেতু পূর্ববাংলার জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকাতেই বসতে হবে। ইয়াহিয়া তা মেনে নিয়ে ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন ডাকলেন। এর আগে তিনি ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার নাটক করলেন। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করলেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে চলছিল অন্য নাটক, বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার নাটক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে লাগল অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী সামরিক সরঞ্জাম আর জাহাজভর্তি সেনা। তৈরি হতে লাগল Èঅপারেশন সার্চলাইটের' বিস্তারিত পরিকল্পনা, যা পরবর্তীকালে এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অনেক সামরিক কর্মকর্তা তঁাদের আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ৩ মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন বসবে তা পিপিপির বাইরের পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নির্বাচিত সদস্যও বিশ্বাস করেছিলেন। হঠাৎ করে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ১ মার্চ রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষিত হলো ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দষ্টিকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এই একটি ঘোষণাই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিদ্রোহের জন্য যথষ্টে ছিল। সে সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের একটি ক্রিকেট খেলা চলছিল। সে খেলা ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা কিনা এ দেশের সব গণতানি্ত্রক আন্দোলনের সূতিকাগার, সেই ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হওয়া অগ্নস্ফিুলিঙ্গ ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। একটাই মূল স্লোগান, Èবীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। নিমেষেই ঢাকা হয়ে উঠল মিছিলের নগর।
পয়লা মার্চের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের স্থগিতাদেশের ঘোষণার পর মূলত সারা দেশের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে, চালু হয় একটি সমান্তরাল সরকার। বর্তমান প্রজন্মকে এটি বোঝানো সম্ভব নয় কেমন ছিল একাত্তরের মার্চ আর কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র এই একটি মানুষই মুখ্য আর সবই গেৌণ, পার্শ্বচরিত্র। মনে করেছিলেন এই একটি মানুষকে দমন করতে পারলে বাঙালিকে শায়েস্তা করা যাবে। তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন পয়লা মার্চের পর প্রত্যেক বাঙালিই একজন শেখ মুজিবে রূপান্তরিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ৩ তারিখ সারা বাংলাদেশে হরতাল আহ্বান করলেন আর ঘোষণা করলেন ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তঁার পরবর্তী ঘোষণা করবেন। বস্তুত ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানের প্রশাসন ও অসি্তত্ব শুধু সেনানিবাসগুলোতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
৭ মার্চের সকালটা ছিল বেশ রেৌদ্রোজ্জ্বল। মূলত সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে জনস্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকে। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, Èকপালে কব্জিতে লালসালু বঁেধে/ এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানার থেকে লোহার শ্রমিক/ লাঙল জোয়াল কঁাধে এসেছিল ঝঁাক বঁেধে উলঙ্গ কৃষক/ পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/ হাতের মুঠোয় মৃতু্যর চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,/ নম্নি মধ্যবিত্ত, করুন কেরানী, নারী, বৃদ্ধা, বেশ্যা, ভবঘুরে/ আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বঁেধে।' এদিন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা বাড়ির ছাদেই উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। বেলা তিনটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে আমরা দল বঁেধে যখন সভাস্থলে পঁেৌছালাম তখন রেসকোর্স এক উত্তাল জনসমুদ্র। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন আসবেন রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জানানো হয়েছিল রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচার করা হবে। সারা দেশের মানুষ রেডিও খুলে অপেক্ষা করছিলেন কী বলেন বঙ্গবন্ধু আর কী নির্দেশনা দেন তা শোনার জন্য। কিন্তু সামরিক প্রশাসনের নির্দেশনার কারণে সেদিন তা আর প্রচারিত হয়নি। তার পরও বিদেশি প্রচারমাধ্যমের সুবাদে মানুষ জেনে গিয়েছিল ভাষণের মূলকথা।
বেলা পেৌনে তিনটা নাগাদ এলেন বঙ্গবন্ধু। প্রায় ১০ লাখ মানুষের জনসমুদ্রে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটি শব্দও যেন শোনা থেকে বাদ না যায়। বঙ্গবন্ধু কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া ১৭ মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা আজকের বাংলাদেশে তো বটেই যত দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে তত দিন সেই ১৭ মিনিটের বক্তৃতা ইতিহাস হয়ে থাকবে। কী ছিল না সেই বক্তৃতায়? ছিল বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-শাসন আর বঞ্চনার ইতিহাস। ছিল বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমি, সঙ্গে ছিল নির্বাচনে জয়ের পর বাঙালির সঙ্গে প্রতারণার কথা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির সামনে একমাত্র যে পথটি খোলা আছে তা হচ্ছে সশস্ত্র যুদ্ধ। তিনি এও বুঝেছিলেন সেই যুদ্ধে তঁার পক্ষে হয়তো শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা সম্ভব হবে না। তা যদি হয় তা হলে করণীয় কী হবে তার নির্দেশনাও দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। সবশেষে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর চেয়ে পরিষ্কার ভাষায় কি আর স্বাধীনতার ঘোষণা হতে পারে? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল জিন্নাহর সাধের পাকিস্তানের এখানেই পরিসমাপ্তি। পরবর্তীকালে অনেকেই তঁাদের স্মৃতিকথায় তা লিখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তঁার অনেক অসাধারণ কীর্তির মধ্যে একটি। অনেকে বলে থাকেন শেখ মুজিব কেন একতরফাভাবে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না? তা যদি তিনি করতেন তা হলে তা হতো একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম নয়। তখন এমন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নাইজেরিয়াতে চলছিল, যা ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পাতা ফঁাদে পা না দিয়ে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে প্রথম গুলিটা পাকিস্তানিদের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছিল বলেই বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রামটি মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়। সমসাময়িক ইতিহাসে কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার একটি বক্তৃতা একটা জাতির ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে, তেমন দ্বিতীয় নজির নেই।
শেষ করি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা শেষ পঙ&ক্তিটা দিয়ে: শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হঁেটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দঁাড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হূদয়ে লাগিল দোলা। কে রোধে তঁাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কঁাপিয়ে কবি শোনালেন তঁার অমর-কবিতাখানি:/ Èএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো।
জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয়তু বাংলাদেশ।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব। ঢাকা।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আর তাদের সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যাশা ও রিপোর্টকে ভুল প্রমাণ করে যখন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হলো তখন তা ছিল তাদের জন্য অনেকটা বজ্রাঘাতের মতো। ১৯৭০-এর আগস্ট মাসে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে (আনুমানিক পঁাচ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল) পূর্ববাংলায় সাধারণ নির্বাচন দুই কিসি্ততে হয়। প্রথমটি ৭ ডিসেম্বর এবং পরেরটি উপকূলীয় অঞ্চলে, ১৯৭১-এর ১৭ জানুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টি সিটের মধ্যে ভুট্টোর পিপিপি ৮৫টিতে জয়লাভ করে যার মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবগুলোই ছিল সন্ধিু ও পাঞ্জাবের। ২০ ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা করেন Èপুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে যেই বিজয়ী হোক না কেন কেন্দ্রে কোনো সরকারই পিপিপির সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া সফল হবে না কারণ পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সন্ধিু ও পাঞ্জাব এবং তা সম্পূর্ণভাবে আমার (ভুট্টোর) নিয়ন্ত্রণে।'
এতেই বোঝা যায় নির্বাচনের পরপরই ভুট্টো পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তথা বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুজিব তো আর ভুট্টোর মতো হঠকারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। তিনি আজীবন নিয়মতানি্ত্রক রাজনীতি করে এসেছেন। বললেন জাতীয় সংসদে আসুন। সেখানে একজনও যদি ন্যায্য কথা বলে তাও মানা হবে। বঙ্গবন্ধু দাবি করলেন যেহেতু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সেহেতু পূর্ববাংলার জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকাতেই বসতে হবে। ইয়াহিয়া তা মেনে নিয়ে ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন ডাকলেন। এর আগে তিনি ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার নাটক করলেন। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করলেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে চলছিল অন্য নাটক, বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার নাটক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে লাগল অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী সামরিক সরঞ্জাম আর জাহাজভর্তি সেনা। তৈরি হতে লাগল Èঅপারেশন সার্চলাইটের' বিস্তারিত পরিকল্পনা, যা পরবর্তীকালে এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অনেক সামরিক কর্মকর্তা তঁাদের আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ৩ মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন বসবে তা পিপিপির বাইরের পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নির্বাচিত সদস্যও বিশ্বাস করেছিলেন। হঠাৎ করে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ১ মার্চ রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষিত হলো ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দষ্টিকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এই একটি ঘোষণাই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিদ্রোহের জন্য যথষ্টে ছিল। সে সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের একটি ক্রিকেট খেলা চলছিল। সে খেলা ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা কিনা এ দেশের সব গণতানি্ত্রক আন্দোলনের সূতিকাগার, সেই ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হওয়া অগ্নস্ফিুলিঙ্গ ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। একটাই মূল স্লোগান, Èবীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। নিমেষেই ঢাকা হয়ে উঠল মিছিলের নগর।
পয়লা মার্চের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের স্থগিতাদেশের ঘোষণার পর মূলত সারা দেশের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে, চালু হয় একটি সমান্তরাল সরকার। বর্তমান প্রজন্মকে এটি বোঝানো সম্ভব নয় কেমন ছিল একাত্তরের মার্চ আর কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। ইয়াহিয়া খান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র এই একটি মানুষই মুখ্য আর সবই গেৌণ, পার্শ্বচরিত্র। মনে করেছিলেন এই একটি মানুষকে দমন করতে পারলে বাঙালিকে শায়েস্তা করা যাবে। তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন পয়লা মার্চের পর প্রত্যেক বাঙালিই একজন শেখ মুজিবে রূপান্তরিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ৩ তারিখ সারা বাংলাদেশে হরতাল আহ্বান করলেন আর ঘোষণা করলেন ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তঁার পরবর্তী ঘোষণা করবেন। বস্তুত ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানের প্রশাসন ও অসি্তত্ব শুধু সেনানিবাসগুলোতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
৭ মার্চের সকালটা ছিল বেশ রেৌদ্রোজ্জ্বল। মূলত সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে জনস্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকে। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, Èকপালে কব্জিতে লালসালু বঁেধে/ এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানার থেকে লোহার শ্রমিক/ লাঙল জোয়াল কঁাধে এসেছিল ঝঁাক বঁেধে উলঙ্গ কৃষক/ পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/ হাতের মুঠোয় মৃতু্যর চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,/ নম্নি মধ্যবিত্ত, করুন কেরানী, নারী, বৃদ্ধা, বেশ্যা, ভবঘুরে/ আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বঁেধে।' এদিন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা বাড়ির ছাদেই উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। বেলা তিনটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে আমরা দল বঁেধে যখন সভাস্থলে পঁেৌছালাম তখন রেসকোর্স এক উত্তাল জনসমুদ্র। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন আসবেন রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জানানো হয়েছিল রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচার করা হবে। সারা দেশের মানুষ রেডিও খুলে অপেক্ষা করছিলেন কী বলেন বঙ্গবন্ধু আর কী নির্দেশনা দেন তা শোনার জন্য। কিন্তু সামরিক প্রশাসনের নির্দেশনার কারণে সেদিন তা আর প্রচারিত হয়নি। তার পরও বিদেশি প্রচারমাধ্যমের সুবাদে মানুষ জেনে গিয়েছিল ভাষণের মূলকথা।
বেলা পেৌনে তিনটা নাগাদ এলেন বঙ্গবন্ধু। প্রায় ১০ লাখ মানুষের জনসমুদ্রে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটি শব্দও যেন শোনা থেকে বাদ না যায়। বঙ্গবন্ধু কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া ১৭ মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা আজকের বাংলাদেশে তো বটেই যত দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে তত দিন সেই ১৭ মিনিটের বক্তৃতা ইতিহাস হয়ে থাকবে। কী ছিল না সেই বক্তৃতায়? ছিল বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-শাসন আর বঞ্চনার ইতিহাস। ছিল বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমি, সঙ্গে ছিল নির্বাচনে জয়ের পর বাঙালির সঙ্গে প্রতারণার কথা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির সামনে একমাত্র যে পথটি খোলা আছে তা হচ্ছে সশস্ত্র যুদ্ধ। তিনি এও বুঝেছিলেন সেই যুদ্ধে তঁার পক্ষে হয়তো শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা সম্ভব হবে না। তা যদি হয় তা হলে করণীয় কী হবে তার নির্দেশনাও দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। সবশেষে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর চেয়ে পরিষ্কার ভাষায় কি আর স্বাধীনতার ঘোষণা হতে পারে? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল জিন্নাহর সাধের পাকিস্তানের এখানেই পরিসমাপ্তি। পরবর্তীকালে অনেকেই তঁাদের স্মৃতিকথায় তা লিখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তঁার অনেক অসাধারণ কীর্তির মধ্যে একটি। অনেকে বলে থাকেন শেখ মুজিব কেন একতরফাভাবে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না? তা যদি তিনি করতেন তা হলে তা হতো একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম নয়। তখন এমন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নাইজেরিয়াতে চলছিল, যা ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পাতা ফঁাদে পা না দিয়ে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে প্রথম গুলিটা পাকিস্তানিদের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছিল বলেই বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রামটি মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়। সমসাময়িক ইতিহাসে কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার একটি বক্তৃতা একটা জাতির ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে, তেমন দ্বিতীয় নজির নেই।
শেষ করি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা শেষ পঙ&ক্তিটা দিয়ে: শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হঁেটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দঁাড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হূদয়ে লাগিল দোলা। কে রোধে তঁাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কঁাপিয়ে কবি শোনালেন তঁার অমর-কবিতাখানি:/ Èএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো।
জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয়তু বাংলাদেশ।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব। ঢাকা।
No comments