অদ্ভুত মিল by সুভাষ সাহা

মানি না, মানবো নার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত এই পোড়ার দেশ থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে উরাল পর্বতমালাকে পেছনে ফেলে শ্বেতভল্লুকের দেশে হাড় কাঁপানো শীতে উত্তাপ ছড়াতে গেল! সোমবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কো আর ঐতিহাসিক নগরী সেন্ট পিটার্সবুর্গের কয়েক হাজার মানুষের স্লোগান আর হাতে ধরা ব্যানার-ফেস্টুনের ভাষা দেখে মনে হতে পারে ঢাকা ও আমাদের অন্য কোনো শহরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় চিরাচরিত মিছিল যেন।


রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইউনাইটেড রাশিয়া দলের প্রার্থী ভ্লাদিমির পুতিনের বিজয় অবধারিতই ছিল। কেউ এই অনিবার্য ফল নিয়ে দ্বিমত আগে করেনি। এমনকি পুতিনের সমালোচনামুখর পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের মওকা পায়নি। এরপরও তারা এবং ভোটে পরাজিতরা এখন নির্বাচনী ফল নিয়ে এমনকি নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন তুলছেন। ভোটে নাকি কারচুপি হয়েছে। বেচারা পুতিন (!) ভোটকে স্বচ্ছ, অবাধ করার জন্য কি-ই না করেছেন! পশ্চিমা গণতন্ত্রের কাছেও যা বিস্ময়কর_ ভোটকেন্দ্রে ক্যামেরা বসিয়ে এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু এতেও পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং বিরোধীদের মন ভরেনি। তারা সমস্বরে ভোটে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে হইচই জুড়ে দিয়েছে। এ যেন ঢাকায় জাতীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর পরাজিত দলের অবস্থানের রিপ্লে। তবে আমাদের এখানে পশ্চিমা মিডিয়াকে বরাবর সহনশীল দেখা গেছে। তবে শেখ হাসিনার দল হারলে দেখা যেত তিনি ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুলছেন আবার আরেক নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল হারলে দলনেত্রী একই অভিযোগ করতেন। দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তাদের বক্তব্যে হেরফের হয়নি। রাশিয়ায়ও এখন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
রাশিয়ায় পুতিনের বিরুদ্ধে সে দেশের মানুষ ভোট দিতে যাবে কেন? তিনি ভেঙে যাওয়া ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়া একটি দেশকে আবার কোমর সোজা করে দাঁড় করিয়েছেন। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে উন্নতি যোগ তার শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারেন না। ইয়েলৎসিনের হাতে খান খান হয়ে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়া যেন পুতিনের নেতৃত্বে দ্রুতই ঘুমন্ত শক্তিমানের মতো ভস্ম থেকে জেগে উঠল। পুতিন রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এলেন_ যেখান থেকে আমেরিকার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়। এ ধরনের একজন শক্তিশালী জাতীয় ব্যক্তিত্বের সামনে বিরোধী প্রার্থীদের উল্লেখ করার মতো কী নেতৃত্বগুণ রয়েছে? ভোটাররা তাদের মূল্যবান ভোট প্রদানের আগে এসব বিবেচনা করবেন না! আর পুতিন প্রদত্ত ভোটের ৬৩ শতাংশেরও বেশি পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট নেতা জুগানভ পেয়েছেন মাত্র ১৭ শতাংশের কিছু বেশি। বিজয়ী এবং পরাজিত প্রধান প্রার্থীর মধ্যে ভোটের বিশাল ব্যবধান সত্ত্বেও বিরোধীরা কিন্তু অবলীলায় মানি না, মানব না চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাবখানা এই_ ভোটে পারিনি তো কী হয়েছে_ আয় তো দেখি মল্লযুদ্ধে নামি, কার কতটা মুরোদ তখন বোঝা যাবে! আমাদের বিগত জাতীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মস্কোয় বিরোধীদের প্রতিক্রিয়ার কী অদ্ভুত মিল!
আসলে যেসব দেশে গণতন্ত্র এখনও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি এবং যেখানে এখনও কোনো না কোনো ফর্মে স্বৈরতন্ত্র চেপে বসার বিপদ মাথায় নিয়েই চলতে হয়, সেসব দেশে নির্বাচনের ফল নিয়ে সরকার আর বিরোধী দলের বাহাস চলতেই থাকে। কোথাও কোথাও এই বাহাস বিপদ ঘনিয়ে আনে। এখানেই ঢাকা আর মস্কোর অদ্ভুত মিল।

No comments

Powered by Blogger.