ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর by তোফায়েল আহমেদ

সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক,


কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগি্নশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত_ নেতার পরবর্তী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ

বছর ঘুরে সাতই মার্চ এলেই মনে পড়ে ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ধাপে ধাপে তিনি একত্রিত করেছিলেন জাতিকে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি জাতির তিনিই একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি। খুব কাছ থেকে এই মহান মানুষটিকে যতটা দেখেছি তাতে কেবলই মনে হয়, আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের কত কিছু শেখার আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে। আওয়ামী লীগ দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজ পরিবারের মতো। দলীয় প্রতিটি নেতাকর্মীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সবার প্রতি ছিল প্রগাঢ় আস্থা, অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আর এ জন্য সবাই তার প্রতি স্থাপন করেছিল গভীর বিশ্বাস। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পর্যন্ত বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতেন। অহংকার আর দাম্ভিকতা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না । তাই তো ১৯৭১-এ তার অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানের গুরুভার অর্পণ করেছিলেন জাতীয় চার নেতাকে এবং তারা সে দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্নও করেছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি, অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনাকালে সবসময় পাশে রাখতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে। সবাইকে সম্মানিত করতেন বলেই বাংলার সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি পেয়েছেন এবং হয়েছেন 'জাতির জনক'।
১৯৭১-এর অগি্নঝরা মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঊর্মিমুখর দিনগুলো আজও চোখে ভাসে। বাঙালি জাতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই সঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতোয় বাঁধা পড়ার দিন সাতই মার্চ। রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ!
১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১২ নভেম্বরের সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৭ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু আমাকে তার নির্বাচনী সফরসঙ্গী করেন। আমার জীবনে এমন জ্যোতির্ময়, হৃদয়বান নেতার সানি্নধ্য আর আসবে না ভাবলেই মন খারাপ করে। বঙ্গবন্ধুকে ওই সময়ে কাছ থেকে দেখেছি, তার চিন্তা-চেতনায় স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি তখন মাত্র ২৭ বছর বয়সের আওয়ামী লীগ দলীয় নগণ্য এক কর্মী। বঙ্গবন্ধু সেদিন আমাকেও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবং আমি জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলাম। নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেই জনগণ নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আমাদের নয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুকেই নির্বাচিত করেছিল। আমরা কেবল জাতির আস্থার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার পথে হাঁটছেন তা পাকিস্তানি শাসকচক্র আর জুলফিকার আলি ভুট্টো বুঝতে পেরেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনেন।
৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। ১ মার্চ সকাল ১০টা থেকে হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সভা চলছিল। একই দিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেন, 'যদি তার পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে ৩ মার্চ অধিবেশন বসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব-নিথর করে দেওয়া হবে।' ১ মার্চ দুপুর ১টায় ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক ঘোষণায় বলেন, 'পাকিস্তানে এখন ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তাই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করছি।' এই ঘোষণার পর উত্তাল ঢাকা যেন আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঘর থেকে জনতা ছুটে আসে রাজপথে, পল্টন ময়দান যেন জনসমুদ্র। সর্বত্র স্লোগান ওঠে, 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। ইয়াহিয়ার ঘোষণায় জনতার রুদ্ররোষে ঢাকা হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরী।
হোটেল পূর্বাণীতে দেশ-বিদেশের অগণিত সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, 'বিনা চ্যালেঞ্জে আমি কোনো কিছুই ছাড়ব না। ছয় দফার প্রশ্নে আপস করব না। ২ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে। সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।' ওই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের ডেকে 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ। কী স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের স্রোত! বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীন বাংলাদেশ তখন সবার হৃদয়ে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা আঁকা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু এলেন, তুমুল করতালি আর স্লোগানের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ হলো। ইশতেহারে বাঙালি জাতির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হয়। ৩ ও ৪ মার্চ এই দু'দিনে চট্টগ্রামে ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ২২ জন আহত হয়। ৫ মার্চ টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৪ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। ৬ মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ৩৪১ জন কারাবন্দি পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিকে ৫ মার্চ পর্যন্ত টানা হরতাল চলাকালে সান্ধ্য আইন জারি হলে বীর বাঙালি তা-ও অমান্য করল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি জাতি এতটাই অবিচল আস্থায় স্বাধীনতার মন্ত্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল যে, তাদের রুখে দাঁড়ানোর সাধ্য আর শাসকের নেই। প্রতিদিন ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে মিলিত হতে থাকে জনতার মিছিল, যেন এই বাড়িটিই বাঙালির ঠিকানা। নেতার নির্দেশ নিয়ে তারা আরও বেশি সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এসএম আহসানকে সরিয়ে 'বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত' টিক্কা খানকে গভর্নর করেন। ১০ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৫ মার্চ ডাকেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তঝরা প্রতিটি দিনের কর্মসূচি নির্ধারিত হতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন_ ইতিহাসের পরতে পরতে স্থান পাওয়া প্রতিটি অর্জনই অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তখন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়েই পথ হেঁটেছে। আমরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুধু কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। ইতিহাস বিকৃতির আস্টম্ফালন দেখি আর ভাবি_ আদর্শচ্যুত হলে মানুষ বোধহয় এভাবেই মিথ্যার মোড়কে সত্যকে গোপন করতে চায়। যারা আজ ইতিহাস বিকৃত করছে, তাদের জন্য ইতিহাস কাঠগড়া নির্ধারণ করে রেখেছে।
আজ সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে বিস্ময় মানি! বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা ছিল যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পেঁৗছে দেওয়ার একেকজন দূত। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝত নেতার ইশারা। জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যেন আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠে একই সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সব মুক্তিপিপাসু সভ্য জাতির অমোঘ মন্ত্র_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
সেদিন ছিল রোববার। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী দুপুর ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রাজ্জাক ভাই, সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মনি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খানসহ আমরা একটি গাড়িতে রওনা করি। নিরাপত্তার জন্য রাজ্জাক ভাই ও গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল। চারদিকে লাখো মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'জয় বাংলা' স্লোগান। কার্যত ১৯৬৯ থেকেই 'জয় বাংলা' স্লোগানটি ছিল বাঙালির রণধ্বনি। বীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন।
রেসকোর্স ময়দানে প্রাণের টানে বাংলার মানুষ বারবার ছুটে আসে। এর আগেও এসেছিল ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে, বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়ে ৩৩ মাস কারাবন্দি থেকে এক অপূর্ব ধৈর্য ও নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মোকাবেলা করেন। মুক্তমানব শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই সেই রেসকোর্স ময়দান যেখানে বাংলার মানুষ শুনেছে এক ইউনিট আর প্যারিটির মৃত্যুঘণ্টা, সত্তরের ৭ জুনে শুনেছে ৬ দফার জয়নিনাদ, আর একাত্তরের ৩ জানুয়ারি শুনেছে ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অগি্নশপথ। আর সাতই মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘমন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। দীর্ঘ ২৩ বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃঢ়তার সঙ্গে আপসহীন অবয়ব নিয়ে নেতা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চে। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে সুশৃঙ্খল ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধুর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদীপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তার সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। যে ভাষণকে বিশেষজ্ঞরা তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের 'গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস'-এর সঙ্গে। সাজানো-গোছানো নির্ভুল ছন্দবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী আস্থা তার প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রধানমন্ত্রিত্ব এমনকি জীবনের চেয়েও কত বেশি প্রিয় তার মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেন_ সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার কথাটিও বললেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ, বোমা হামলার প্রস্তুতি। কিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলো।
সাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। সেই সুরে বীর বাঙালির মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিল। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব জানিয়েছিলেন, ৬ মার্চ সারারাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন, তিনি কী বলবেন তার জনগণকে তা নিয়ে। বেগম মুজিব বলেছিলেন, 'তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।' নেতা বলছেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই।'
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগি্নশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত_ নেতার পরবর্তী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ। কী উত্তেজনাময়, আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এত কোলাহল, এত মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণে সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন 'জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার।' তাই তো জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ, আশ্চর্য বাঙালির মন ও মানস।
সাতই মার্চের রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন 'ভাইয়েরা আমার' বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, '...প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।' ১১০৮টি শব্দ সংবলিত ১৭ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, বাঙালি জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রূপরেখা আর নিজের চরম ত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি_ জনশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগি্নশপথে ভাস্বর, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দৃঢ় শপথ আর আত্মত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' হৃদয়ে ধারণ করে সংগ্রামী জনতার দীপ্ত স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা রাজনৈতিক সংগ্রামে আমরা জয়যুক্ত হয়েছি এবং ভৌগোলিক স্বাধীনতা, সংবিধান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে আজও আমরা জয়যুক্ত হতে পারিনি। অদ্যাবধি আমরা সেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি বিধায় সাতই মার্চের ভাষণের আবেদন এখনও অটুট, এখনও স্থায়ী জাতির মননে-হৃদয়ে-চেতনায়। সাতই মার্চ অনন্য-অবিস্মরণীয়।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য; সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
tofailahmed69@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.