লিনা লুসাই-যেতে হবে বহুদূর by ইমাম হাসান

ছোট্ট বেলা থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভালো। অষ্টম শ্রেণীতে উঠে তো রীতিমতো বোমা ফাটিয়ে দিলেন লিনা জেসমিন লুসাই। গতানুগতিক ধারা ভেঙে সেবার ক্লাসে প্রথম হলেন বান্দরবানের এই আদিবাসী মেয়েটি। একে তো একজন আদিবাসী তার ওপর আবার লুসাই মেয়ে! যেখানে বাংলাদেশে লুসাইদের জনসংখ্যা মোট এক হাজারেরও কম! সেবার


আলোচনা তাই লিনাকে ঘিরেই। মা সব সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আর সে পথেই একটু একটু করে এগোচ্ছেন লিনা লুসাই। সবাই ভবত মেয়েটি হয় চিকিৎসক, না হয় প্রকৌশলী হবে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল করে দিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পর লিনা ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়ার বিষয় হিসেবে বেছে নেন লোকপ্রশাসন। তবে অনার্সে প্রথম দিন ক্লাসে কাগজে লিখেছিলেন ‘ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছার পালেও লাগে নানা দোলা।
অনার্স শেষ করেই বৃত্তি পান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে পড়াশোনা করেন ‘ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ বিষয়ে। ২০০৯ সালে পড়ালেখা শেষ করেই নিজের দেশে। তার মতে, ‘চাইলেই হয়তো দেশে ভালো কোনো চাকরি করতে পারতাম। কিন্তু নিজের ইচ্ছা আর দেশের টানে ফিরে আসা।’ বর্তমানে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও)। তাদের ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অন ইনডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পিপল ইস্যুজ অ্যান্ড গুড গভর্ন্যান্স’ প্রকল্পের প্রোগ্রাম সাপোর্ট কনসালট্যান্ট। ‘নিজের পছন্দের বিষয়েই কাজ করছি। তাই ভালো লাগাটা একটু বেশি’ বলে জানান লিনা লুসাই।
নিজ সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা হয় কবে থেকে? উত্তরটা দিতে গিয়ে একটু থামলেন তিনি। তারপর জানালেন, ‘১৯৯৫ সালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে পুলিশের দাঙ্গা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে তখন থমথমে অবস্থা। দাঙ্গায় আমাদের ঘর-বাড়ি পুড়ে যায়। তখন থেকেই নিজেদের দাবি আদায়সহ আদিবাসীদের উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছাটা আলতো করে দানা বাঁধে। ভাবতাম, সুযোগ পেলে পার্বত্য এলাকার এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।’
আইএলওতে কাজ করার সুবাদে নানা স্থানে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন লিনা। তুলে ধরার চেষ্টা করছেন আদিবাসী সমাজের বিভিন্ন দিক। কাজ করছেন আদিবাসী সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের অ্যাসিটেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবেও। নিজের ভেতরে ‘আমি পারব’ এই ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো কাজ সম্ভব মনে করেন লিনা।
‘এখন অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী ভালো ফল করছে। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। হয়তো এখন তারা মনে করছে পারব। তাই পারছে। সুযোগ পেলে আদিবাসী মেয়েরাও ভালো কিছু করতে পারে। আর তাই তাদের সুযোগ দিতে হবে। সব স্থানে নারীদের এগিয়ে দিতে হবে। আর এই দায়িত্ব নিতে পারে তার সমাজ বা জনগোষ্ঠী।’ বলে জানান লিনা জেসমিন লুসাই। আদিবাসী তরুণ ও নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে চান লিনা। তবে এ জন্য নারীকেও তার নিজের খোলস ছেড়ে বাইরে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। প্রাধান্য দিতে হবে নিজের কাজকে।
নিজেকে কোথায় দেখতে চান সামনে, প্রশ্নের জবাবটি দিলেন ঝটপট। ‘আমি কাজ করছি নিজের কমিটমেন্টের মধ্যে। তাই সামনে কোথায় যাব তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটি বুঝি যে “লাত্্্্্ তাক্্্্্্ আহ্্্্ কাল্্্্্ দিং আঙাই” অর্থাৎ যেতে হবে বহুদূর।’

No comments

Powered by Blogger.