রাশিয়া-পুতিনের প্রত্যাবর্তন by মশিউল আলম

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির Èস্বৈরশাসনের' অবসানের পর পঁুজিবাদী রাশিয়ায় যে Èগণতানি্ত্রক' ব্যবস্থা এসেছে, দীর্ঘ দুই দশকেও তা রাশিয়ার পশ্চিমা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিতে ভ্লাদিমির পুতিন এক জবরদস্ত একনায়ক; তঁার মধ্যে কেবল যে স্তালিনের দুরাত্মার বাস শুধু তা-ই


নয়, তিনি নাকি অক্টোবর-বিপ্লবের আগের জারদের মতো স্বৈরতন্ত্রী। রাশিয়ায় সত্যিকার গণতানি্ত্রক রীতিনীতির বিকাশ ও আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা ও সাবেক কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যই। পুতিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, স্বাধীন মত প্রকাশে সোচ্চার সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর তঁার দমনপীড়নের রেকর্ড নাকি জারদের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা যারা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের চশমায় রাশিয়াকে দেখি, আমাদের চোখেও পুতিনের চেহারাটা গণতন্ত্রী নয়, যতই তিনি গণতানি্ত্রক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসুন না কেন। দুবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চার বছর কাটিয়ে তৃতীয়বারের মতো তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং মনে করা হচ্ছে, চতুর্থবারও তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন। অর্থাৎ সামনের আরও আট বছর ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ায় গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখবেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ানসহ পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যম কী করে এই সত্য অস্বীকার করবে যে ভ্লাদিমির পুতিন আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে? তারা তা অস্বীকার করছে না। তবে পরাজিত প্রার্থী ও তঁাদের সমর্থকদের বরাত দিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে রাশিয়ায় রোববারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। পরাজিত প্রার্থীরা এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন, নির্বাচনের পরের দিন সোমবার সন্ধ্যায় মস্কোয় এক দফা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করার পর পুতিনের বিরুদ্ধে বড় রকমের বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেছেন তঁারা। বিশেষ করে, নির্বাচনী ফলাফলে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী গেন্নাদি জুগানভের কমিউনিস্ট পার্টির পুতিনবিরোধী আন্দোলন আগের চেয়ে বেগবান হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেও তারা মস্কো শহরে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনের বিজয়ের পর তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম আরও জোরদার হবে বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু পুতিনের থেকে জুগানভের দূরত্ব অনেক। পুতিন ভোট পেয়েছেন ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ, ভোটার সংখ্যার হিসেবে চার কোটি ৪৯ মানুষ তঁাকে ভোট দিয়েছে। আর জুগানভ পেয়েছেন মাত্র ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, মাত্র এক কোটি ২০ লাখ। তৃতীয় স্থান অধিকারী স্বতন্ত্রপ্রার্থী মিখাইল প্রোখারভ পেয়েছেন জুগানভের থেকেও অনেক কম, ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পুতিন একাই যত ভোট পেয়েছেন, অন্য সব প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে তার অর্ধেকও হয় না।
নির্বাচনে কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ (ওএসসিই) ও কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস (সিআইএস) থেকে আসা আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোববারের নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় ৭০০ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক রাশিয়া গিয়েছিলেন, দেশীয় পর্যবেক্ষকেরাও ছিলেন। ভোটকেন্দ্রগুলোতে বসানো হয়েছিল এক লাখ ৮০ হাজার ওয়েব ক্যামেরা। অবশ্য তাই বলে নির্বাচন শত ভাগ সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। রাশিয়া বিশাল বড় দেশ, অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে∏যেমন ককেশীয় চেচনিয়া, দাগেস্তান ইত্যাদি এলাকায় কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে। ওই সব অঞ্চলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ছিল দুর্বল, সরকারপন্থী অর্থাৎ পুতিনের পক্ষের লোকজনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি। রাশিয়ার স্থানীয় বেসরকারি পর্যবেক্ষণ সংস্থা গোলাসের পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, নির্বাচন অবাধ হয়নি, নিরপেক্ষও হয়নি। তঁারা নানা ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। যেমন∏একই ব্যক্তির একাধিকবার ভোট দেওয়া, টাকা দিয়ে ভোট কেনা, ব্যালটবাক্স ভরানো। কিছু কিছু জায়গায় কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শ্রমিকদের পুতিনকে ভোট দেওয়ার জন্য হুকুম করা হয়েছে∏এ রকম অভিযোগও পাওয়া গেছে। কিছু কিছু জায়গায় মুঠোফোনের ভিডিও ক্যামেরায় ভোটকেন্দ্রের অনিয়মের চিত্র ধারণ করা হয়েছে। ককেশীয় অঞ্চলের এ রকম একটি অনিয়মের ভিডিওচিত্র রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার ভ্লাদিমির চুরোভ সেটা দেখে মন্তব্য করেছেন, স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গুরুতর ভুলের কারণে ওই ভোটকেন্দ্রে অমন জালিয়াতি ঘটতে পেরেছে।
ভোট গ্রহণে কোনো অনিয়ম-কারসাজি না হলে পুতিন হয়তো ৬৩ শতাংশ ভোট পেতেন না, আরও কম পেতেন। কিন্তু কত কম পেতেন? জুগানভের চেয়ে কম? এমন কথা কেউই ভাবেননি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমেও নির্বাচনের আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, পুতিনই যে জিতবেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, রোববারের নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। পুতিন এক সময় যত জনপ্রিয় ছিলেন, এখন তার চেয়ে অনেক কম জনপ্রিয়। কিন্তু এখনো তিনি রাশিয়ার রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছেন।
পুতিনের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পরও রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ এখনো মনে করে, পুতিনের ওপর ভরসা করা যায়। রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুরবস্থা অনেকখানি দূর হয়েছে। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের দুর্দশা কেটে গিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইয়েলৎসিনের রাশিয়া যেভাবে পাশ্চাত্যের বশংবদ হয়ে পড়েছিল, রাশিয়ার মানুষ তা পছন্দ করেনি। তারা চিরকাল পাশ্চাত্যকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। তারা বিশ্বাস করে না ইউরোপ-আমেরিকা রাশিয়ার উন্নতি চায়। রাশিয়াকে পাশ্চাত্যের বশংবদ অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিজের পায়ে দঁাড় করিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন; রুশি জাতীয়তাবাদের গেৌরব তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। তঁার জনপ্রিয়তার এটি একটি বড় কারণ। নির্বাচনের পরের দিন প্রাভদা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে লিজা কারপোভা নামের এক পুতিন-ভক্ত লিখেছেন, Èগণতন্ত্র কাকে বলে পুতিন তা সমস্ত পশ্চিমা নেতাদের চেয়ে অনেক ভালো জানেন। তঁাদের কাছ থেকে কোনো উপদেশের দরকার নেই।' তঁার মতে, পশ্চিমাদের চোখে গণতন্ত্র মানে ওয়াশিংটন/তেল-আবিবের হুকুম মেনে চলা। পশ্চিমা গণতন্ত্র মানে বোমা, বুলেট আর ব্ল্যাকমেইল।
কিন্তু শুধু পরাশক্তির হারানো গেৌরবের নস্টালজিয়ার কারণেই যে রাশিয়ার মানুষ পুতিনকে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে, তা-ও বলা যায় না। বিকল্প নেতৃত্বের অভাবও আরেক বড় কারণ। রাশিয়ায় অনেক বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হয়নি, যঁাদের মধ্য থেকে জনগণের পছন্দের নেতাকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো সোভিয়েত আমলের স্মৃতিকাতরতায় ভুগছে, কিন্তু তাদের মধ্যেই এমন অনেক মানুষ আছে, যারা মনে করে পুতিন রাশিয়ার বর্তমান স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারবেন। তঁাদের পেনশন বেড়েছে। বেশি নয়, তবু তো বেড়েছে। জীবন আগের চেয়ে একটু সহজ হয়েছে। আর অগ্রগতি না হোক, এটুকুই যেন থাকে। পুতিনের ওপর তঁাদের ভরসা, তিনি পারবেন। তিনি তাদের কাছে Èবাতুশকা ৎসার'∏সেই Èবাপু জার', যে শক্ত হাতে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রজাসাধারণের দেখভাল করতে পারে। এরা গণতন্ত্র বোঝে না, ওই বস্তুটা যে কী, তা জানেও না। অন্তত তিন শতাব্দী ধরে রাশিয়ার সাধারণ মানুষ একজন Èভালো জারের' ওপর ভরসা রেখে জীবন ধারণ করতে চেয়েছে। লেনিন, স্তালিন, ব্রেঝনেভ∏সবার মধ্যেই তারা একজন ভালো জারকে খুঁজে পেতে চেয়েছে।
কিন্তু তাহলে পুতিনের বিরুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করছে, তারা কারা? তাদের একটা বড় অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতিকাতর বয়স্ক জনগোষ্ঠী; জুগানভকে ভোট দিয়েছে তারা। আরও একটা অংশ আছে, যারা রাশিয়ায় জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের মতো গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের বিকাশ দেখতে চায়। এরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী। এদের একটি বড় অংশ ভীষণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইন্টারনেটের ব্লগভুবনে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এরাই ঘোষণা করেছিল, রাশিয়ায় তারা আরব বসনে্তর বাতাস বইয়ে দেবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করে রাশিয়ায় সুপরিচিত ব্লগার আলেকসেই নাভালনি নির্বাচনের পরের দিন ইন্টারনেটে ঘোষণা দিয়েছেন, পুতিনবিরোধী আন্দোলনকে পরিণত করা হবে Èওয়ালস্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনের মতো লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে; কম্বল-তঁাবু নিয়ে সবাইকে তিনি ক্রেমলিন চত্বরে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্দ্রেই সাখারভ যে রাশিয়ার স্বপ্ন দেখতেন, এই তরুণ-যুবক-মধ্যবয়সী নারী-পুরুষেরা সেই রাশিয়া পেতে চান। পুতিন তঁাদের কাছে একজন স্বৈরতন্ত্রী একনায়ক, যঁার আমলে কয়েক ডজন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, যিনি Èগোয়েন্দা ও মাফিয়া পদ্ধতি'তে গণতানি্ত্রক রাজনৈতিক বিকাশের পথগুলোতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলেছেন।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.