৭ই মার্চের ভাষণের ভাষাগত বিশ্লেষণ by আব্বাস উদ্দিন আহমেদ

পরাধীন একটি জাতি। চলছে যুগ-শতাব্দীব্যাপী নিরন্তর সংগ্রাম; আছে সফলতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান। এভাবেই নানা বৈষম্যের শিকার স্বাধিকার আর স্বাধীনতায় উন্মুখ একটি জাতিকে স্বপ্নের শিখরে তুলতে ধারাবাহিক অনুশীলনের একপর্যায়ে স্বাধীনতার মূল মন্ত্রে উজ্জীবিতকরণে কী ধরনের দিকনির্দেশনা দিতে হবে- পাঠক, এসব প্রশ্নের প্রায় শতভাগ


উত্তরসংবলিত একটি বক্তব্য বা ভাষণের কথা চিন্তা করুন। এই বঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে হিসাবটা কষলে আপনিও কি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বেছে নেবেন? শতাব্দী বা হাজার বছর নয়, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিগন্ত নিয়ে আলোচনায় নামার ধৃষ্টতা আমার নেই। সমাজসচেতন একজন নাগরিক হিসেবে ৭ই মার্চের ভাষণের নবরূপায়ণ ও মূল্যায়নের প্রত্যাশায় আমার এই বিনম্র উপস্থাপন। বঙ্গবন্ধুর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর জমিরুদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণা- "শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে আমি সেদিন সারা দিন তাঁর সঙ্গে ছিলাম।... যখন উনি মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন উনার বেগম সাহেবকে এবং আমাকে সামনে রেখে তিনি কী বক্তৃতা দেবেন তা তিনি একটু আওড়াচ্ছিলেন এবং তখন তিনি এ কথা বলেননি, 'আমি আজকে ময়দানে গিয়ে স্বাধীনতার ডিক্লারেশন দেব'।" বিষয়টি একটু পরখ করা যাক।
৭ই মার্চের ভাষণটিকে ১১টি পর্বে বিভক্ত করে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন- উজ্জীবন পর্ব : আত্মত্যাগ আর সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে যেন ইতিহাসের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত করতে চান তিনি। উত্থাপন পর্ব : এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গ টেনে ষড়যন্ত্রের জালটা যেন জাতিকে তিনি দেখাতে চান। উদ্দীপন পর্ব : জনসমুদ্রের দৃষ্টিসীমা ছাপিয়ে যায় ঘটনাপ্রবাহের দ্রুত পটপরিবর্তনে। উদ্বোধন পর্ব: এরপর 'শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল' পালনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এ জাতি স্বাধীনতাসংগ্রামে নিজেদের প্রস্তুত করে তুলল। এ ছাড়া উদ্ভাবন পর্ব, উন্মীলন পর্ব, উদ্যাপন পর্ব, উৎপাদন পর্ব, উত্তোলন পর্ব, উচ্চারণ পর্ব, আহ্বান পর্বে ভাগ করা যায়। এভাবেই ৭ই মার্চের ভাষণটি কেবল এ দেশবাসীর নয়, বিশ্ববাসীর জন্য হয়ে ওঠে স্বাধিকার আর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এক মোহনীয় ও ঐন্দ্রজালিক কথামৃত- সঞ্জীবনী সুধা; যাকে কেউ কখনো যুগ আর শতাব্দীর ফ্রেমে, মানচিত্রের জালে কিংবা ভাষার পিঞ্জরে আটকে রাখতে পারে না। ৭ই মার্চের ভাষণে বাংলার পাশাপাশি বেশ কিছু বিদেশি শব্দের সমাবেশ ঘটেছে, যা পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে ধারণ করে শতভাগ অগ্রগতি এনে দিয়েছে। উত্তাল জনসমুদ্রের ন্যায় হিমালয়সদৃশ প্রত্যাশাপূরণে তাই ভাষার এমন মণিকাঞ্চন যোগ কতটা হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, তা খুঁটিয়ে দেখা যাক।
আরবি : আদালত, ইনশাআল্লাহ্, খতম, খাজনা, খালি, গরিব, গোলাম, জারি, তারিখ, দফা, দাবি, মালিক, মোকাবিলা, শহীদ, সাহেব, হুকুম; ফারসি : কারখানা, খান, চালান, জামা, জোর, দফতর, দরজা, দোকান, মহল্লা, মাইনে (মাহিনা), মুসলমান, হিন্দু; হিন্দি : কাচারি, গদি, গুলি, পেঁৗছে, ফেরত, সামনে; গুজরাটি : হরতাল, জাপানি : রিক্শা, দ্বিভাষা :- আওয়ামী লীগ (আরবি+ফারসি), কসাইখানা (আরবি+হিন্দি), ফৌজদারি (আরবি+ফারসি), বদনাম (ফারসি+সংস্কৃত), বৈঠক (হিন্দি+সংস্কৃত), লুটতরাজ (সংস্কৃত+ফারসি); ইংরেজি : Assembly, Bank, Barrack, Call, Court, February, General, High Court, Judge Court, June, Launch, Majority, Party, March, Martial Law, Member, National News, President, Radio, Relief Committee, Round Table Conference, Secretariat, Semi-government, Station, Supreme Court, Tax, Telegramme, Telephone, Television, WAPDA,Withdraw.
স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাসে কতটা সার্থক হয়েছে, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, এতে এক ঐন্দ্রজালিক বহুমাত্রিক উপাত্তের সমন্বয় ঘটেছে। হতে পারে তা পরিবেশ-পরিস্থিতি ধারণ করতে এবং জনতার (প্রকারান্তরে দেশবাসী) অভিব্যক্তির
বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে।
শব্দ ও বাক্য বিশ্লেষণ : কালিক বিচারে বাক্যবিভাজন, কালিক বিচারে হ্যাঁ/না-এর প্রয়োগ, প্রশ্নবাচক সর্বনাম, নির্বাচিত অব্যয়ের মার্জিত প্রয়োগ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আর ইতিহাসের বিবর্তনের সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্বের মেলবন্ধন লক্ষণীয়।
যুগোপযোগী হয়েও যুগোত্তীর্ণ এ ভাষণে একাদশ অমৃতভাষ্য অর্থাৎ ১১ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। বাক্য গঠনে বহুরূপী শব্দের সমন্বয় ঘটায় এমনটি হয়েছে বলে মনে হয়। দু-একটি আঞ্চলিক ও তদ্ভব শব্দ, আধুনিক ও পরিশীলিত চলিত গদ্য, নির্বাচিত তৎসম শব্দসহ সময়োপযোগী বেশ কিছু বিদেশি শব্দে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে। বাক্য গঠনেও একাদশ তরঙ্গিনী প্রবাহিত হয়েছে- অনুরোধ, আদেশ, উদ্দীপনা, কৌশল, জবাবদিহিতা, দৃষ্টান্ত স্থাপন, নির্দেশনা, প্রতিবাদ, যুক্তি প্রতিষ্ঠা, সতর্কতা প্রদর্শনসহ সংশয় প্রকাশের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সরকারের কাছে দুটি আবেদন করতে চাই- ১. ৭ই মার্চের এ ঐতিহাসিক ভাষণটির ওপর ব্যাপক গবেষণা এবং মাধ্যমিক স্তর থেকে ডিগ্রি পর্যায়ে পাঠ্যতালিকাভুক্তকরণসহ দেশব্যাপী প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ২. সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও পাঁচ ভাষাশহীদের ওপর বিশেষ নিবন্ধসংবলিত স্বতন্ত্র প্রামাণ্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করে তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অন্তত ২০ নম্বরের বিশেষ পরীক্ষা (ষাণ্মাসিক- ১০ লিখিত, বার্ষিক- ১০ ব্যবহারিক) প্রবর্তন করে নূ্যনপক্ষে শতকরা ৬০ নম্বরপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিশেষ সনদপ্রাপ্তি নিশ্চিত হলেই উত্তীর্ণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
লেখক : গবেষক

No comments

Powered by Blogger.