এতিম শিশুদের প্রতিবাদ-কেবলই দু'মুঠো ভাতের জন্য ...

প্রবাদ আছে_ 'না কাঁদলে মা দুধ দেয় না।' নাটোর সরকারি শিশু পরিবারে আশ্রিত শ'খানেক শিশুর দুর্ভাগ্য যে, তারা অভিভাবকহীন ও ঠিকানাবিহীন। ওদের একটাই পরিচয়_ এতিম! কার কাছে চাইবে খাবার? কাকে বলবে কষ্টের কথা? ওদের মায়ের স্নেহ-যত্ন-আদর দিয়ে লালনপালনের ভার নিয়েছিল সমাজসেবা অধিদফতর।


কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান সরকারেরই অঙ্গ, তাই কথা ও কাজের মধ্যে সঙ্গতি থাকতে নেই যে। শিশুরা এতদিন মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে আসছিল। পেটপুরে তিনবেলা ভাত চাইলে 'হাভাতে' বলে গালমন্দ করা হয়েছে। অখাদ্য খাবার দেওয়া হয়েছে। ১০০ গ্রাম দুধ এক বালতি পানিতে গুলিয়ে তা খেতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু সবকিছুরই শেষ থাকে। 'দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া' বলে একটা কথা আছে। নাটোরের শিশু পরিবারে আশ্রিতদের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে। বঞ্চনা-নির্যাতনের প্রতিবাদে রোববার তারা নাটোর-রাজশাহী মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় 'তিনবেলা পেটপুরে খেতে চাই' শিরোনামের খবরটি পাঠ করে যে কেউই অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারবে না। খবরের সঙ্গে থাকা ছবি থেকে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ওইসব শিশু নিদারুণ অপুষ্টির শিকার। তাদের সঙ্গে থাকা একটি পোস্টারে লেখা, 'অত্যাচারের শেষ কোথায়?' রাজপথ-রেলপথ অবরোধ সাধারণভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ওই শিশুরা যখন এমনটি করেছে তার সমর্থনে উচ্চকণ্ঠ হতে কারও দ্বিধা করা উচিত নয়। অবরোধের কারণে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে একটি বড় এলাকার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার যানজট। কিন্তু এ কারণে যাদের অশেষ কষ্ট হয়েছে তাদের সমবেদনাই বরং ছিল ওদের জন্য। শিশুরা মরিয়া হয়েই এমন পথ বেছে নিয়েছে সেটা সবাই বুঝতে পারে এবং বলা যায়, ফলও পেয়েছে হাতে হাতে। সোমবার সমকালসহ আরও কয়েকটি দৈনিকে খবরটি প্রকাশের পর ওইদিনই দুপুরে দেওয়া হয়েছে ডিম-ডাল-সবজি দিয়ে ভাত। নতুন জামা উঠেছে গায়ে, বিছানায় পাতা হয়েছে নতুন চাদর। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। খাবার, পোশাক, চিকিৎসা, শিক্ষা, খেলাধুলার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সমস্যার দ্রুত সমাধানে মিলেছে আশ্বাস। আশা করব, এতিম শিশুদের আকুতি বিফলে যাবে না। দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত হবে এবং এ জন্য দায়ীদের শাস্তি হবে। তবে একটানা 'ত্রিশ বছর ধরে খাবার ও অন্যান্য পণ্য' সরবরাহকারী ঠিকাদারদের ওপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়ার যুক্তি নেই। দুর্মূল্যের বাজারে '২০ টাকা কেজি দরে কৈ মাছ' সরবরাহের জন্য তার দরপত্র যারা গ্রহণ করেছেন, গলদ খুঁজতে হবে সেখানে। নাটোরের সরকারি শিশু পরিবারের এতিমদের কান্নায় অন্যান্য সরকারি শিশু পরিবারে আশ্রিতদের দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটতে শুরু করলে সেটা হবে উপরি কিন্তু যথার্থ প্রাপ্তি। একটি প্রতিষ্ঠানের শিশুরা সাহসী হয়েছে, কিন্তু অন্যরা মুখ বুজে সব সহ্য করছে বলে যেন ধরে নেওয়া না হয় যে 'সবকিছু ঠিক আছে।' এতিমখানা নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও সরকারের বাড়তি মনোযোগ প্রত্যাশিত।

No comments

Powered by Blogger.