ব্রিটেনে বাঙালিদের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন পরাভূত ফ্যাসিস্ট ইডিএল by ফারুক যোশী

লন্ডনের পর সম্ভবত এই প্রথম বাঙালিরা এককভাবে বর্ণবাদী কোনো আক্রমণ রুখল সুশৃঙ্খলভাবে এবং তা-ও নর্থ-ওয়েস্টের একটি ছোট্ট শহর হাউডে। একটা টান টান উত্তেজনা ছিল সারা শহরে। দেখেছি অন্তত ১৫-২০ দিন থেকে বাঙালি কমিউনিটিতে তরুণদের ফুঁসে ওঠা।


কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ কিংবা ব্যবসায় যুক্ত তরুণরা কিভাবে ফুঁসে উঠছে। যে কমিউনিটিতে দেখেছি গ্রাম্য-দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠি নিয়ে জটিলতা, সেই কমিউনিটিও তাদের চরম দুঃসময়ে একাট্টা হয়েছে। প্রতিদিন এরা সভা করেছে, দিনে, রাতে জেগে। কখনো বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার সেন্টারে, কখনো বা মসজিদে শত-সহস্র মানুষের জমায়েত। এ জমায়েত কমিউনিটিকে যেন প্রতিদিনই একটা বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। কমিউনিটির এই বন্ধন স্থানীয় কাউন্সিলকে (টেইমসাইড কাউন্সিল) বলতে গেলে একটা ধাক্কা দিয়েছে। গ্রেটার ম্যানচেস্টার পুলিশ ফোর্সে এ নিয়ে ছিল এক চরম উত্তেজনা। কাউন্সিল-পুলিশ প্রতি সপ্তাহেই এ নিয়ে সভা করেছে কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে।
উল্লেখ্য, এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতের স্নো-বল ছোড়াছুড়ির একটি ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক শেতাঙ্গ যুবক বাঙালি যুবকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হলে উগ্রবাদী ইংলিশ ডিফেন্স লিগ (ইডিএল) সহসা একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল শনিবার। হাইড শহরের দুটো স্থান তারা টার্গেট করেছিল, যেখানে বাঙালি কমিউনিটির বসবাস। স্থানীয় কমিউনিটির প্রবল প্রতিবাদ কাউন্সিলকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য করে টাউন হল কিংবা প্রধান শহরের বাইরে একটা জায়গায় ইডিএলের মার্চ কিংবা সমাবেশের স্থান নির্ধারণ করে দিতে। কমিউনিটির আশাতীত সাড়া পায় স্থানীয় কাউন্সিল এবং পুলিশ ফোর্স। দাঙ্গা রুখতে অর্ধশতাধিক স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয় কমিউনিটি থেকে। যারা দক্ষতার সঙ্গে তারুণ্যের উচ্ছৃঙ্খলতা রোধ করতে পেরেছিলেন। ৩৭০ জন অতিরিক্ত পুলিশসহ পাঁচ শতাধিক পুলিশ সারা শহর ঘিরে রাখে। গ্রেটার ম্যানচেস্টার পুলিশ ইডিএলের এই মার্চ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। আর সে জন্যই ঘণ্টাব্যাপী হেলিকপ্টার টহল দিয়েছে ইডিএলের মার্চ চলাকালীন সময়ে। কাউন্সিল সূত্র জানিয়েছে, শহর পরিচ্ছন্নতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে একটি বিল ইতিমধ্যে ইডিএল নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ দিনের অস্থিরতা কিংবা সম্ভ্যাব্য দাঙ্গা ঠেকাতে শুধু পুলিশের অতিরিক্ত খরচই হয়েছে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড। গ্রেটার ম্যানচেস্টার পুলিশও তাদের এ অর্থের একটা বিল পাঠাচ্ছে ইডিএলের কাছে।
কিন্তু তবুও কমিউনিটির মানুষ এ মার্চকে সহজভাবে নিতে পারেনি। পুলিশের প্রতি আছে তরুণদের ব্যাপক অভিযোগ। ইডিএলের মার্চের সুযোগে আরেক বর্ণবাদী দল বিএনপি (ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) স্থানীয় মার্কেটে একটি সভা করার সুযোগ পায়। ৫০-৬০ জনের উপস্থিতিতে এই সভায় বিএনপির চেয়ারম্যান ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্য নিক গ্রিফিন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়ান। যদিও এ সভা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। সভা করেছে বিএনপি, অথচ বাঙালি এলাকায় তখন পুলিশ যেন দেয়াল তুলে দিয়েছিল। যদিও পুলিশ কাকুতি-মিনতি করেছে বাঙালি তরুণদের, তারা যেন রাস্তা পার না হয়। কিন্তু বাঙালি এলাকায় ক্রমেই মানুষের সমাগম বেড়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা ইডিএল কিংবা বিএনপিকে দিয়েছে অন্য বার্তা। ইডিএল কিংবা বিএনপির কর্মীদের একটা বড় অংশ মূলত ফুটবল হুলিগান। তাদের একটা ধারণা হয়তো ছিল, পাঁচ-ছয় হাজার বাঙালির আবাস হাইড একটি ছোট্ট শহর। এই শহরে ইডিএলের ওই ফুটবল হুলিগানরা মার্চ করতে এলে চুপসে যাবে কমিউনিটি এবং তারা তাদের বর্ণবাদী আন্দোলনের একটি সফলতা পেয়ে যাবে। কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি হাইডের বাঙালিরা। বরং যেভাবে শোনা গিয়েছিল হাজার দেড়েক ইডিএল হুলিগানের পদভারে বাঙালি কমিউনিটি কাঁপবে, সেই গর্জনও মিইয়ে যায়। সর্বোচ্চ ৪০০ (বলা হচ্ছে ৬০০) হুলিগান এসেছিল এবং বলতেই হয়, বাঙালিদের একতাবদ্ধ হওয়ার কারণে তারা কিছুটা হলেও চুপসে যায়। তাদের এই লংমার্চ কোনো বার্তাই পৌঁছাতে পারেনি, এমনকি স্থানীয় সাদা মানুষগুলোর মধ্যেও। অন্যদিকে কামউনিটির একটি সফল প্রতিরোধের কারণে বাঙালি তরুণরাও কোনো ধরনের ভায়োলেন্সে যায়নি। আর সে কারণে মূল গণমাধ্যমগুলোতে ইডিএলের প্রত্যাশিত মার খাওয়ার চিত্রটা তুলে ধরতে পারেনি মিডিয়া। যদিও উগ্র বর্ণবাদী আচরণ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং মাতাল হওয়ার দায় নিয়ে ১১ জন ইডিএল কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ওইদিন। স্বাভাবিকভাবে তাই মিডিয়া লুফে নিতে পারেনি এই মার্চ। কারণ জঙ্গি কিংবা মুসলিম দাঙ্গাবাজ উল্লেখ করে ফোকাস করার কোনোই ক্লু পায়নি মূলধারার মিডিয়াগুলো। কেননা কোনো বাঙালিকেই গ্রেপ্তার করার সুযোগ পায়নি পুলিশ। যদিও উচ্ছৃঙ্খলতা ঠেকাতে গিয়ে কমিউনিটির দু-একজন সমন্বয়ক সাময়িক পুলিশি হয়রানিতে পড়েছিলেন।
স্থানীয় কাউন্সিলের লিডার, ডেপুটি লিডার, কাউন্সিলরবৃন্দ, হাউস অব কমন্সের স্থানীয় এমপি হাইড মসজিদে কিংবা ওয়েলফেয়ার সেন্টারের পাশে থেকে জনগনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন। কিন্তু সত্যটা হলো, নর্থ-ওয়েস্টের কোনো কমিউনিটি নেতাকে দেখা যায়নি কমিউনিটির এই চরম দুঃসময়ে। নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে কমিউনিটি লিডারদের সংখ্যা কম নয়। আছেন জনপ্রতিনিধিও। মওকা পেলে টিভির ক্যামেরায় মুখ দেখানোর জন্য কিংবা স্থানীয় পত্রিকায় ছবি ছাপানোর দৌড়ে তাঁরা কেউ কম যান না। অথচ ব্রিটেনের জাতীয় প্রচারমাধ্যমে হাইডের বাঙালি নিয়ে এত নেগেটিভ প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও হাইডের বাইরের, বিশেষত ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যামের কোনো কমিউনিটি নেতাদের এখানে উপস্থিতি চোখে পড়েনি। এমনকি একাত্মতা প্রকাশের জন্যে অন্তত একটিবারের জন্যে কারো দেখা মেলেনি। অথচ লন্ডন থেকেও মানুষ খোঁজ নিয়েছে কি হচ্ছে হাইডে তা জানতে। এখানে একটা ব্যাপার ছিল লক্ষণীয়। এই শহরেও আছে বাংলাদেশি রাজনীতির স্পর্শ, আছে ইসলামী ভিন্ন চিন্তার বিতর্ক। কিন্তু এই বিতর্কের ঊধর্ে্ব উঠতে পেরেছিল কমিউনিটি। মৌলবাদ কিংবা প্রগতিবাদিতা এখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। কেউ তোলেনি মৌলবাদ আর প্রগতিবাদিতার ধুয়া। এমনকি লন্ডনে বিভিন্ন সময় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার নির্বাচনে কিংবা বর্ণবাদবিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোতেও মাঝে মাঝে মৌলবাদী-প্রগতিশীল প্রভৃতি বিতর্কে আন্দোলন হোঁচট খেতে দেখেছি আমরা। আন্দোলনের নেতৃত্ব কার হাতে যাবে- এ নিয়ে হাইডেও সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা ছিল, কিন্তু সময়ের অনিবার্যতার কাছে একসময় সব কিছুই হার মানে। কারন তরুণরা এতইফুঁসে উঠেছিল যে কমিউনিটির নেতাদের সামান্যতম ত্রুটিও হাইডে একটি রক্তাক্ত অধ্যায় রচনা করতে পারত, আর সে জন্যই হাইডের এই ছোট্ট কমিউনিটিকে সাধুবাদ।
আমরা বিশ্বাস করি, হাইডের বাঙালিদের এই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ইতিহাসেরই একটি অংশ হয়ে থাকবে। ব্রিটেনের বাঙালিদের বিভিন্ন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে তা বিবেচিত হবে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে। হাইডের উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও দেখা গেছে এই প্রজন্মের জেদী তরুণরাও বয়স্কদের সম্মান করেছে এবং কমিউনিটি নেতাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণেই সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামা মোকাবিলা করেছে এই কমিউনিটি। সার্থক এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে হাইডের কমিউনিটিতে সৃষ্টি হয়েছে এক আশ্চর্য বন্ধন, তরুণদের সঙ্গে বয়স্কদের। এই কমিউনিটির মানুষের বিশ্বাস, গোষ্ঠী কিংবা গ্রাম্য দ্বন্দ্ব অবসান হয়ে এখানে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা, নতুন বন্ধন। এই বন্ধনকে অটুট রাখতে পারলেই এ কমিউনিটি আরো সমৃদ্ধ হতে পারে, এ কথাগুলোই বলছেন কমিউনিটির সবাই, বিশেষত তরুণরা, এক বাক্যে। আমরা মনে করি, হাইডের এই ঐক্য সারা ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে একটা সাফল্যের নতুন ইতিহাস হিসেবেই আগামীর আন্দোলন-সংগ্রামে পথ দেখাবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.