কৃতী তিন কন্যা by রুহিনা তাসকিন

খবরটা এসেছে সংবাদপত্রের পাতায়। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনজন পান স্বর্ণপদক। তিনজনই মেয়ে। গর্বের বিষয় বটে।বিশ্বব্যাপী এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূলভাবনা যখন ‘নারীদের যুক্ততা আলোকিত ভবিষ্যতের প্রেরণা’ তখন এই তিন মেধাবী মেয়ে আমাদের অবশ্যই আশা জাগান


নকশিকাঁথার কাজ করা নীল পোশাক আর হ্যাট পরে তিনজন দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। আলোকচিত্রীর অনুরোধে তুলে ধরলেন গলার মেডেলটাও। মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি। কোনটা বেশি ঝলমল করছিল—হাসি না পদক? ছবি দেখেই বুঝে নিতে হবে। অর্জনটাও যে তাঁদের অসামান্য! ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম সমাবর্তনে তাঁরা পেয়েছেন আচার্য স্বর্ণপদক। অর্থাৎ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন তাঁরা। নওরিন নওশাবা, নুসরাত জাহান আর মারিয়া মতিন—তিন কৃতীর সঙ্গে কথা হলো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এবার স্বর্ণপদক পাওয়া তিনজনই নারী। এ ব্যাপারে বাইরে যতটা আলোচনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তেমন নয় বলে জানান তিনজনই। ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই শিক্ষার্থী। ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু এখানে নেই। আর আমরা চাই, বিষয়টা যেন সব ক্ষেত্রে এমনই হয়। ছেলের সাফল্য না মেয়ের, এভাবে যেন কোনো কিছু দেখা না হয়।’ তিনজনেরই এমন মত।
ধারাবাহিক পরিশ্রমেরই ফল পেয়েছেন তিনজন। ছোটবেলা থেকেই ভালো ফল করে আসছেন তাঁরা। এই সাফল্য তাই অনেক দিনের অধ্যবসায়েরই স্বীকৃতি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পদক পেয়েছেন নওশাবা। আর বাকি দুজন পেয়েছেন স্নাতক পর্যায়ে অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। নওশাবা স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন স্নাতক পর্যায়েও, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পরিবারের উৎসাহ আর সহযোগিতা পাওয়াটা বড় ভূমিকা রেখেছে তাঁদের এই অর্জনে। তবে নওশাবাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। স্নাতক শেষ করার পরই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। সন্তান জন্মের পর পড়াশোনায় তিন বছরের বিরতি নেন। এরপর আবার পড়া শুরু করে মনোযোগ ধরে রাখা, সংসার আর সন্তানের দেখাশোনা, নিয়মিত ক্লাস করা—সব সামলে জয়ী হয়েছেন নওশাবা। ‘আমি মনে করি, আমার জীবনের সবকিছুই আমার নিজের হাতে। আমি চাইলেই সাফল্য পেতে পারি। আর আমার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িও যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাঁদের ভরসায়ই মেয়েকে রেখে ক্লাস করেছি। পরীক্ষার আগে রাত জেগেছি। খুব দোটানায় পড়তাম, যখন আমার মেয়েটা হাত ধরে বলত, “আম্মু, আসো আমরা খেলি, আর পড়তে হবে না।” ওর মুখের দিকে চেয়ে কষ্ট হতো। এক হাতে নোটস আর আরেক হাতে ওকে নিয়ে পড়তে বসতাম।’ বলেন তিনি
একই বিভাগের শিক্ষার্থী মারিয়া ও নুসরাত। তবে তাঁদের সাফল্যের সূত্রটা দুই রকম। ‘প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে পড়াশোনা করেছি। কোনো ক্লাস বাদ দিইনি। তবে সপ্তাহ শেষে একদিন বিরতি দিতাম।’ বলেন নুসরাত। ওদিকে মারিয়া পড়ার বাইরেও নানা ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা, আড্ডা—সবই করেছি। চাপ না দিলে কোনো কাজই আমার করা হয় না। তবে আমার বিষয়গুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।’ বলেন তিনি।
নিয়মিত ক্লাস করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেন নওশাবাও।
বন্ধুরা কখনো প্রতিপক্ষ ভাবেননি তাঁদের। এটাও অনেক সাহায্য করেছে তাঁদের। ‘আমরা যেমন ফলই করি, আমাদের বিভাগ থেকেই কেউ সর্বোচ্চ নম্বর পাক।’ বন্ধুরা সব সময় নুসরাতকে এসব বলে উৎসাহ দিতেন বলে জানান তিনি। আর গ্রুপ স্টাডিতে মারিয়াকে ধরেবেঁধে পড়ানোর কাজটাও সহপাঠীরাই করতেন বলে জানালেন মারিয়া।
আর শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা তো আছেই। নুসরাত আর মারিয়া তাঁদের বিভাগের শিক্ষক ওয়াসেকুর রহমানের কথা বলেন, ‘তাঁর পড়ানোর ধরনটা দারুণ। উনি যেন আমাদের মনের কথা পড়তে পারেন। কে বুঝল না, কে একটু পিছিয়ে আছে—সবই ধরে ফেলেন তিনি।’
নওশাবা কৃতজ্ঞ অধ্যাপক নাইয়ুম চৌধুরীর প্রতি। তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতিই শ্রদ্ধা জানাতে চান তাঁরা।
এছাড়াও আর একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন তাঁরা। সেটা হল, পছন্দের বিষয়টিতে পড়তে পারা। নুসরাত বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। কিছুদিন ক্লাস করে বুঝলাম কোন আগ্রহ পাচ্ছিনা। তখন চলে এলাম ব্র্যাকে। মা-বাবা সমর্থন দিয়েছিলেন আমার সিদ্ধান্তে।’
এখন তো ভালো ফল হলোই। এর পরের পরিকল্পনা কী? তিনজনই জানালেন গবেষণাধর্মী কাজে আগ্রহের কথা। নওশাবার মা মারা গেছেন ক্যানসারে। এর প্রতিরোধে কাজ করার ব্রত তাঁর সেই সময় থেকেই। নুসরাত আগ্রহী পরিবেশবিষয়ক অর্থনীতিতে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে তো আমাদের ভাবতেই হবে।’
মারিয়া এখনো গবেষণার বিষয়টি ঠিক করেননি। আপাতত এই মুহূর্তটাই উপভোগ করছেন। ‘কিছুদিন পর তো আরও সিরিয়াস হতেই হবে।’
বিয়ে বা মা হওয়া—কোনোটাই বাধা হয়নি নওশাবার সাফল্যে। অন্য মেয়েদের বেলায় তা হতে পারে বলেও মনে করেন না তিনি, যদি পরিবারের সমর্থন থাকে। তবে বাকি দুজন এখনই ভাবছেন না বিয়ের কথা। আপাতত নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করাই তাঁদের একমাত্র ভাবনা। জানিয়ে দিলেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.