চারদিক-ডালাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস by তমাল তাহসীন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ&যাপন উপলক্ষে ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাসে (ইউটি ডালাস) হয়ে গেল এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের (বিএসও) পক্ষ থেকে ছিল এই আয়োজন। ২০০১ সালে ইউটি ডালাসে বিএসওর প্রতিষ্ঠা হয়।


প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিএসও বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করার প্রচষ্টো চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাসহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষাকে কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠানের উদ্যোগ। বিএসও ছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও অংশ নেয় ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন অব চায়নিজ স্টুডেন্টস অ্যান্ড স্কলারস, মেক্সিকান অ্যাসোসিয়েশন অব স্টুডেন্টস, কোরিয়ান আন্ডারগর্্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, টার্কিশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, মিডল-ইস্টার্ন স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, জাপানিজ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং থাইল্যান্ডের ছাত্রছাত্রীরা।
অনুষ্ঠান শুরু হয় সমগ্র বিশ্বে ভাষাবৈচিতর্্যের গুরুত্ব এবং তার আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ইউটি ডালাসের এন্ডাউড প্রফেসর এবং সেন্টার ফর ট্রান্সলেশন স্টাডিজের পরিচালক ড. রেনার শুলটের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে। তিনি তঁার বক্তব্যে অনুবাদ এবং এর চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ড. শুলটে বলেন, Èআমরা যদি বিদেশি ভাষার কোনো বক্তব্যকে এর প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে নিজেদের মাতৃভাষায় সহজভাবে অনুবাদ করতে পারি, তাহলেই কেবল সেই বক্তব্য সত্যিকার অর্থে কিছুটা হলেও অনুধাবন করা সম্ভবপর হতে পারে।' এরপর ইউটি ডালাসের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেস অফিসের (আইএসএসও) সহকারী পরিচালক লিসাবেথ লযাসিটার একটি সংক্ষপ্তি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিলাভের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বল্পদৈর্ঘয তথ্যচিত্র দেখানো হয়। তথ্যচিত্রটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শাকিল মোহাম্মদ। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চেৌধুরীর Èকঁাদতে আসিনি, ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি' আবৃত্তি করে শোনান বাংলাদেশের ইয়াসির খান। এরপর নুমাইর চেৌধুরী তঁার রচিত বাবু বাংলাদেশ বই থেকে নেওয়া কিছু অংশের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনান।
চীনা ভাষা এবং ঐতিহ্যকে পরিচয় করিয়ে দিতে ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন অব চায়নিজ স্টুডেন্টস অ্যান্ড স্কলারসের পক্ষ থেকে ক্ল্যাসিক লাহুয়াংমেই অপেরার একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা ভাষার গান পরিবেশন করা হয়। বৈশ্বিক ভাষাবৈচিতর্্যের ধারাবাহিকতায় জাপানিজ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ক্ষুদ্র পরিসরে তাৎক্ষণিক মনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে লিখিত ঐতিহ্যবাহী Èহাইকু কবিতা' আবৃত্তি করে।
নিজের ভাষায় কথা বলতে চাওয়ার ইচ্ছেটিকে Èসেলিব্রেট ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ' প্রামাণ্যচিত্রটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষায় নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করে। বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে এ প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন মোহাম্মদ নাফিস বিন নাসিম ও সারতাজ আমিন খান এবং এটি সম্পাদনা করেন তেৌফিক হাসান। এরপর থাইল্যান্ডের দুজন শিক্ষার্থী Èলাউ ডুয়াং ডুয়েন' শিরোনামে একটি ধ্রুপদ থাই সংগীত পরিবেশন করেন। সর্বাধিক কথিত ভাষার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে স্প্যানিশ ভাষা। এই ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী মেক্সিকান অ্যাসোসিয়েশন অব স্টুডেন্টস দুটি দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করে। সৈয়দ শামসুল হকের Èআর কত রক্তের দাবি' কবিতাটি পড়ে শোনান জেসমিন সুলতানা।
গান ও কবিতার পর এবার নাচ নিয়ে আসে মিডল ইস্টার্ন স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। তারা মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী দাবিকা-নৃত্য পরিবেশন করে। দাবিকা মূলত প্যালেস্টাইন, লেবানন ও জর্ডানের সংস্কৃতির অংশ। এরপর ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে ইনগ্রিড মাইকেলসনের গান Èদ্য ওয়ে আই অ্যাম' নিয়ে মঞ্চে আসেন জিন রো। উপমহাদেশীয় ঐতিহ্যকে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরার জন্য ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করা হয়, যার মূলে ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি এবং এর অন্তর্বর্তী ভাষাবৈচিতর্্য।
অুনষ্ঠানের শেষাংশে ছিল বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের পরপর কয়েকটি পরিবেশনা। সমবেত সংগীত Èমুক্তির মন্দির সোপানতলে' গেয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএসওর সদস্যরা। গানের পর একে একে দুটি নাচ পরিবেশন করা হয়। প্রথমে Èজয় করবে বাংলাদেশ' শিরোনামে সমবেত নৃত্য নিয়ে আসেন রুবানা, স্বর্ণা ও আশফিয়া। দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত এ নাচটি অনুষ্ঠানটিকে একটি সাবলীল মাত্রা দেয়। ইফফাত শারমিন ও ইশিতা শারমিন এরপর বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আরও একটি নাচ পরিবেশন করেন। সবশেষে মঞ্চে আসেন তেৌফিক হাসান এবং ইউটি ডালাসের বাংলাদেশি ছাত্রদের নিয়ে তৈরি ব্যান্ড ধূমকেতু। এর সদস্যরা একে একে বেশ কয়েকটি বাংলা গান পরিবেশন করে অনুষ্ঠানটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন। ধূমকেতুর সদস্যদের তঁাদের গাওয়া গান সম্পর্কে মন্তব্য করতে বললে তঁারা বলেন, বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের গান করতে পারাটাই তঁাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস। তঁারা বিশ্বাস করেন, তঁাদের গাওয়া বাংলা গানগুলোর মাধ্যমে তঁারা বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন ভাষার লোকজনের কাছে পরিচিত করতে পারবেন। ধূমকেতুর এই পরিবেশনার পরপরই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
তমাল তাহসীন

No comments

Powered by Blogger.