নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-দোষারোপের রাজনীতি, কোন্দলের রাজনীতি by বিশ্বজিৎ চেৌধুরী

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের গাড়িতে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার। গাড়িবহরে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়েছিল, হামলার কারণ ও উদ্দেশ্য জেনেই আওয়ামী লীগের দিকে আঙুল তুলেছেন তিনি।


কিন্তু পরদিনই পত্রপত্রিকায় দলের স্থানীয় রাজনীতিতে মোরশেদ খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত এরশাদ উল্লাহ বলেছেন, তঁার অনুগত কর্মীরা এম কে আনোয়ারকে ফুল দিতে গেলে মোরশেদ খান বাধা দেন, এতে কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তঁার গাড়িতে হামলা করেছে। হামলার ঘটনাটি যে দলীয় কোন্দল থেকেই হয়েছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এরশাদ উল্লাহকে দল থেকে বহিষ্কার। তাহলে এম কে আনোয়ারের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যে একটি মিথ্যা অভিযোগ জানালেন তার কী হবে? তিনি কি ভুলের জন্য Èদুঃখিত' হয়ে তঁার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন? না, করবেন না। কারণ আমাদের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিতে এই Èদুঃখ প্রকাশের' রীতি নেই। বরং তিনি যে জেনেশুনে তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেন, কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করতে পারলেন, এটাকেই রাজনৈতিক কেৌশল হিসেবে বিবেচনা করবেন তিনি ও তঁার দল। বলতে দ্বিধা নেই আওয়ামী লীগ হলেও তা-ই করত। এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা (ক্রেডিবিলিটি) হারাচ্ছেন রাজনীতিকেরা। Èবাঘ আসছে বাঘ আসছে' বলে যে রাখাল বালকটি প্রতিদিন ধঁোকা দিত গ্রামবাসীকে, তার পরিণতি আমরা সবাই জানি, জানেন না শুধু এই রাজনীতিকেরা।
আসলে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্ত। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চেৌধুরী, মন্ত্রী আফছারুল আমীন, সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসির নানামুখী তৎপরতা ও বিরোধে জর্জরিত নগর আওয়ামী লীগ কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি দীর্ঘদিন। এখন কেন্দ্রের কাছে ধরনা দিয়ে একটি কমিটির জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছেন এই নেতারা। চাপিয়ে দেওয়া সেই কমিটি ঘোষণার পর যে সবাই আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবেন, সব ভুলে ঝঁাপিয়ে পড়বেন দলের শক্তি বৃদ্ধির কাজে তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সাংসদ আখতারুজ্জামান চেৌধুরী আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনীত হওয়ার পর চট্টগ্রামে তঁাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হলো তাতে একযোগে শামিল হয়েছেন স্থানীয় প্রায় সব নেতা। মঞ্চে একসঙ্গে হাতে হাত ধরে কর্মীদের আশ্বস্ত করেছেন তঁারা, Èআমরা ঐক্যবদ্ধ'। কর্মীরা কি তা বিশ্বাস করেছেন? মনে হয় না। কারণ এখানেও সেই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে এসে দঁাড়ায়। এই কর্মীরাও তো দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে আছেন, অনেক কিছু দেখার অভিজ্ঞতা তঁাদের হয়েছে। এর আগেও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যস্থতায় বা ঘরোয়া সামাজিক অনুষ্ঠানে বিবদমান নেতাদের একে অন্যকে জড়িয়ে ধরা বা সব অতীত ভুলে পরস্পরকে কাছে টেনে নেওয়ার নাটক তঁারা দেখেছেন। পত্রপত্রিকায় এ রকম ছবিও ছাপা হয়েছে। কিন্তু নাটক শেষে যে যঁার অবস্থানে ফিরে গেছেন, দলীয় কোন্দল রয়ে গেছে আগের জায়গাতেই।
তবে হঁ্যা, এর মধ্যে মেরুকরণ হয়েছে নানা রকম। যেমন, আ জ ম নাসিরউদ্দিনের নাম শুনলে একসময় ভ্রু কুঁচকাতেন মহিউদ্দিন চেৌধুরী, দীর্ঘদিন নগর কমিটির সদস্যপদেও নাসিরকে রাখতে অনীহা ছিল তঁার। আজ সেই মহিউদ্দিন চেৌধুরী চাইছেন এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে আসুক আ জ ম নাসির উদ্দিনের নাম। গত সংসদ নির্বাচনের সময় রাজনীতিতে নবাগত আবদুচ ছালামকে (বর্তমানে সিডিএ চেয়ারম্যান) চান্দগঁাও-বোয়ালখালী আসনে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে দল ও জোটের (মঈনুদ্দীন খান বাদল) প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি মহিউদ্দিন, আজ সেই আবদুচ ছালাম যোগ দিয়েছেন তঁার বিপক্ষ শিবিরে। শত্রুর-শত্রু আমার মিত্র এই নীতিতে আফছারুল আমীন ও নুরুল ইসলাম বিএসসি আজ এককাট্টা, অন্যদিকে মহিউদ্দিনের অনুসারীদের হাতে একসময় লাঞ্ছিত সাংসদ এম এ লতিফ আজ তঁার Èঘরের মানুষ'। নেতাদের এ রকম শত্রু-মিত্র খেলায় কর্মী-অনুসারীরা বিভ্রান্ত, দিশেহারা। এ রকম Èদিশাহীন' কর্মী দিয়ে আর যা-ই হোক দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা যে কত দুরূহ, তার ছোট উদাহরণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড। কিছুদিন আগে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষের পর নিজেদের সভাপতিকেই ছাত্রশিবিরের চর বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ! এভাবে দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিভেদ-কোন্দল। নগরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নেতারা খঁুজছেন তঁাদের অনুগত কর্মী, সেই সূত্রে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ছে পাড়া-মহল্লায়ও।
বিএনপির অবস্থা আরও করুণ। জন্মলগ্ন থেকে এ দলটি চট্টগ্রামে বিভেদে কোন্দলে জর্জরিত। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে। সেবারও তিনি এসেছিলেন বিবদমান নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে কোন্দল নিরসন করতে। এত বড় টর্্যাজেডির পরও বিভেদ কোন্দল থেকে মুক্ত হতে পারলেন না বিএনপি নেতারা!
চট্টগ্রাম অভিমুখে বিএনপির সাম্প্রতিক রোডমার্চের আগে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। রোডমার্চের সমন্বয়ক ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা এম কে আনোয়ার। তখন এক মঞ্চে এসে কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান, আমীর খসরু মাহমুদ চেৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন ও শাহাদাৎ হোসেন। এক মঞ্চে বিবদমান নেতাদের দেখে কর্মী-সমর্থকেরা যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, তেমনি কেৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও। যঁারা পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা সময়ে বিষোদ্গার করেছেন, দলীয় সমাবেশে প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্রভাব ঠেকাতে হামলা চালানো হয়েছিল যঁাদের নির্দেশে, তঁারা যখন একই মঞ্চে হাসিমুখে পাশাপাশি বসেন, তখন তা কেৌতূহলোদ্দীপক বৈকি। মনে পড়ে, এ রকম একটি সভায় নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, Èএত দিন আমাদের বিভক্তির কথা লিখেছ, এবার আমাদের ঐক্যের কথাটাও লিখে দিয়ো।' সাংবাদিকেরা লিখেছিলেন, কিন্তু ঐক্য তো ঠেকেনি। রোডমার্চে সাফল্যে উজ্জীবিত কর্মী-সমর্থকেরা যখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে Èঐক্যবদ্ধ' নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে, তখন উত্তর জেলা যুবদলের নতুন কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল গিয়াসউদ্দিন কাদের চেৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারের সমর্থকেরা, দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে মোরশেদ খানের সমর্থকদের সঙ্গে এরশাদ উল্লাহর সংঘর্ষে বিব্রত হয়ে পড়ল এমনকি কেন্দ্রও। কর্মীরা আবার দিশাহীন, Èঐক্য নাটকের' ছবিটা এখন বন্দী হয়েছে স্মৃতির ফ্রেমে।
এভাবে নানামুখী দ্বন্দ্বে-কোন্দলে বড় দুটি দলের স্থানীয় নেতারা নিজের দলের ভেতরই খেলছেন শত্রু শত্রু খেলা। না দলীয় কাজে, না জনকল্যাণে∏কোনো দিকেই মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় তঁাদের নেই। নেই বলেই বিএনপির সরকারের আমলে এ অঞ্চল থেকে ছয়-ছয়জন নেতা মনি্ত্রত্ব পেয়েও কিছুই করতে পারেননি জনগণের জন্য। মেয়াদ শেষে এক-এগারোর সরকারের সময় কেউ দুর্নীতির অভিযোগে জেল খেটেছেন, কেউ বিদেশে পালিয়ে বঁেচেছেন। এবার আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রামের মন্ত্রী সাকল্যে দুজন, তঁাদের একজন স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নন।
এভাবে কেন্দ্রের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছেন চট্টগ্রামের রাজনীতিকেরা। একসময় এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চেৌধুরীদের মতো রাজনীতিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল জাতীয় রাজনীতিতে, আজ আখতারুজ্জামান চেৌধুরী সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য মনোনীত হলেই স্তুতি আর সংবর্ধনার জোয়ারে ভাসেন!
কারণে-অকারণে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ-কোন্দলের জন্য অন্য দলকে দায়ী করার প্রবণতা বাড়ছে, এই বে্লম-গেমের কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, নিজের দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্যতা বা শ্রদ্ধা-সমীহ হারাচ্ছেন নেতারা। আদর্শ-বিচু্যত, উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো, শাসন করার মতো মনোবল এই নেতাদের কি আর অবশষ্টি আছে?
বিশ্বজিৎ চেৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.