বিশেষ সাক্ষাৎ কার-নেপালকে গণতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক করতে চাই by বাবুরাম ভট্টরাই

গত ২৮ আগস্ট মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই নেপালের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বাবুরাম ভট্টরাইয়ের এ সাক্ষাৎ কারটি নেওয়া হয়। তখন নেপালের তৎ কালীন টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাওবাদীদের আবারও ক্ষমতায় আসার গুঞ্জন চলছিল।


দুই ঘণ্টার আলাপচারিতায় নেপালের তৎ কালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা, মাওবাদীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলাপ হয়। প্রায় দুই বছর আগের সেই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তা প্রকাশ করা হলো।

১৯৫৪ সালের ১৮ জুন নেপালের গুর্খা জেলার বেলবাস কপলং গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবুরাম ভট্টরাইয়ের জন্ম। তিনি ভারতের চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যকলায় সম্মান ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাওবাদীদের প্রধানতম তাত্ত্বিক হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। ২০০৬ সালে নেপাল সরকার ও মাওবাদীদের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়, তাতে বাবুরাম ভট্টরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালের এপ্রিলে নেপালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাবুরাম সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ও সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন। প্রথম গণতান্ত্রিক নেপালের অর্থমন্ত্রী হিসবে দায়িত্ব পালন করেন।
 সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো  কী ধরনের সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আপনাদের লক্ষ্য?
বাবুরাম ভট্টরাই  আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য নেপালকে একটি ফেডারেল রিপাবলিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে প্রতিটি এলাকাকে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করা হবে। তাদের প্রত্যেকের স্বায়ত্তশাসন থাকবে। সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চলবে। এতে নিপীড়িত জাতি, বর্ণ ও ধর্মের অধিকার সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নিশ্চিত হবে। আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই। বিশেষ করে, কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করার উদ্যোগ নেব। এর আগে আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি, সমবায় আন্দোলনসহ যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলাম, তা আবারও পূর্ণ উদ্যমে চালু করব। যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমাদের যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, সেটা উন্নত করার চেষ্টা করব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়াসহ যে ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলার উদ্যোগ নেব। ভারত, চীন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।
প্রথম আলো  নেপালের মাধেসিরা তরাই অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। ফেডারেল সরকারব্যবস্থা তো নেপালকে অনেকগুলো রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলবে।
বাবুরাম ভট্টরাই  নেপালের নিপীড়িত জাতিগুলো স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে, এটা ঠিক নয়। তারা স্বায়ত্তশাসন চাইছে। কোনো একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে যদি আপনি অবদমিত করে রাখেন তাহলে তারা স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে যেতে বাধ্য হয়। আমরা যে ফেডারেল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, তাতে প্রতিটি জাতি, বর্ণ ও অঞ্চলের মানুষের মতামতকে রাষ্ট্র পরিচালনায় গ্রহণ করা হবে। তারা নিজেরা স্বায়ত্তশাসিত থেকে ঐক্যবদ্ধ নেপালের জন্য কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। কোনো জাতিগোষ্ঠী যদি নিজেদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে পায়, তাহলে তারা কেন স্বাধীন রাষ্ট্র চাইবে। আমরা অনেক ছোট দেশ। একে আর ভাগ করতে গেলে সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে।
প্রথম আলো  ভারতের মাওবাদীরা তো পশ্চিমবঙ্গের লালগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন করছে? বাংলাদেশেও বিভিন্ন মাওবাদী দল সক্রিয়। তাদের ব্যাপারে আপনাদের মূল্যায়ন কী?
বাবুরাম ভট্টরাই  ভূস্বামীদের শোষণ ও বঞ্চনার কারণেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মাওবাদীরা সক্রিয় হয়েছে। সেখানে শোষণ যত তীব্র হবে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন তত বেশি শক্তিশালী হবে। আমরা নেপালে যে সফলতা অর্জন করেছি, তার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে পড়ছে। তবে আমরা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে আন্দোলন করেছি। জনগণের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করলে সমর্থন পেতে সমস্যা হয় না। অনেক বামপন্থীর মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য না থাকায় তারা সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক বামপন্থী দল আছে। আমি যতটুকু জানি তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আছে। অবশ্য এতে কোনো সমস্যা নেই। নেপালেও একসময় এমনটা ছিল। আমরা সব প্রগতিশীল ছোট দলকে একত্র করেছিলাম। জনগণের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে কাজ করলে ছোট দলও বড় হয়ে উঠতে পারে। আমরা নিজেরাই তার প্রমাণ।
প্রথম আলো  ভাষা প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান কী?
বাবুরাম ভট্টরাই  নেপাল একটি বহুভাষিক দেশ। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ নেপালি ভাষায় কথা বলে। ফলে এটাই আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা। তবে অন্য সব ভাষার অধিকারও থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। কোনো ভাষাই চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমি বা আপনি যদি নিজের ভাষা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিই, তার পরিণতি কখনোই ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে না।
প্রথম আলো  আপনারা যে মাও সে-তুংয়ের আদর্শের অনুসারী কিন্তু তার দেশ তো এখন পুরোপুরি পুঁজিবাদী অর্থনীতির বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।
বাবুরাম ভট্টরাই  চীন আমাদের কাছে একটি বড় শিক্ষা। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ থাকা অবস্থায় একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করেছে। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদ প্রগতিশীল ব্যবস্থা। ফলে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীনের উৎ পাদিকা শক্তির যে বিকাশ হয়েছে, তা ভবিষ্যতের সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথকে আরও সহজ করে দিয়েছে। সামনের দিকে সম্পদের সুষম বণ্টন অনেক সহজ হবে। আমি মনে করি মাও সে-তুং চীনের আর্থসামাজিক অবস্থার যে বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন, তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আমরা মাওয়ের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে গণতান্ত্রিক ও শিল্পভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি।
প্রথম আলো  এককেন্দ্রিক বিশ্বের একটি নির্দিষ্ট দেশে বিশেষ করে নেপালের মতো ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে না থাকা দেশে কত দিন সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব?
বাবুরাম ভট্টরাই  আমি মনে করি পৃথিবীতে এখন সত্যিকার অর্থে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের শর্ত তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। উৎ পাদিকা শক্তির অনেক বিকাশ হয়েছে। সারা বিশ্ব একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়া শুরু করেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য এই সম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যাদের একটি অংশ ক্রমশ সম্পদ অর্জন করছে অপর অংশ আরও দরিদ্র হচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে শোষণ-বৈষম্য আরও বাড়ছে। বিশ্বায়নের কারণে সবাই তা জানতে পারছে। এই নিয়মে একটি সমাজ বেশি দিন টিকতে পারে না। এখনই সময় মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বৈষম্য শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা। কেননা, একমাত্র সমাজতন্ত্রই পারে মানুষের প্রকৃত শোষণ ও বৈষম্য দূর করতে। মানব জাতিকে মুক্ত করতে।
প্রথম আলো  বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
বাবুরাম ভট্টরাই  ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমার প্রচুর বাংলাদেশি বন্ধু ছিল। তাঁরা এখন নিজ দেশে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশও নেপালের মতোই একটি দরিদ্র দেশ। অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক। আমাদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কও রয়েছে। এখানে যে নেপালি টুপি বিক্রি হয়, তা একসময় ঢাকাই টুপি হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকার সুতি কাপড়ও নেপালে খুব জনপ্রিয়। আমার দল বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর পক্ষে। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ হোক, তা-ও আমরা চাই। তবে দুই দেশেই অনেক পশ্চাৎ পদ উপাদান রয়ে গেছে। বৈষম্য ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো একই রকমভাবে সক্রিয়। পার্থক্য হচ্ছে, আমরা পাহাড়ে আর বাংলাদেশ সমতলে। নেপাল থেকে সৃষ্টি হয়ে বেশির ভাগ নদী বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। আমরা একই অববাহিকার সন্তান। এই নদীগুলোর পানি ব্যবহার করে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ একই রকমভাবে লাভবান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে আমরা সঠিক মনে করি।
প্রথম আলো  নেপালে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আঞ্চলিক উদ্যোগের কথা উঠেছিল।
বাবুরাম ভট্টরাই  হ্যাঁ, নেপালে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে আমরা হিমালয়কেন্দ্রিক নদী অববাহিকার সবগুলো দেশ লাভবান হব। নেপাল ও বাংলাদেশ উভয় দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোসি নদীর ওপর সপ্তকোসি ড্যাম ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে আমাদের, তাতে কোনো আপত্তি নেই। হিমালয় থেকে সৃষ্ট নদীগুলোকে পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবহার করে আমরা এই অঞ্চলের সব মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
বাবুরাম ভট্টরাই  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.