পাঁচ মাসেও পুরোপুরি চালু হয়নি পরিবেশক প্রথা-* দুর্বল মনিটরিং সেল -* অনেক বাজারে পরিবেশক নেই -* কাজ করছে না জেলা ও উপজেলা কমিটি by রাজীব আহমেদ

পুরনো ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) প্রথা উঠিয়ে দিয়ে পরিবেশক প্রথা চালুর পর প্রায় পাঁচ মাস পার হলেও প্রথাটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এ জন্য তদারকির দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবেশক ছাড়াও পণ্য বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। অনেক বাজারে পরিবেশক না থাকায় খুচরা বিক্রেতাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই সারা দেশে এক দাম কার্যকর করা যাচ্ছে না। আর খুচরা ক্রেতাদের জন্য ছোট মোড়কে পণ্য সরবরাহ করার শর্তও পালিত হচ্ছে না।


আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেল ও চিনির দাম নিম্নমুখী থাকায় দেশের বাজারেও এ দুটি পণ্যের দাম কমেছে। সে কারণে পরিবেশক প্রথা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যেই হচ্ছে নিয়মের লঙ্ঘন।
ডিও প্রথার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়_দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে এ অভিযোগ আসার পর সরকার অর্ধশতাব্দী প্রাচীন এ প্রথা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার পর গত ২১ জুন থেকে চালু হয় পরিবেশক প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী কম্পানির নির্দিষ্ট পরিবেশকরা নির্ধারিত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহ করবেন। খুচরা বিক্রেতারাও নির্দিষ্ট দামে ওই পণ্য বিক্রি করবেন। প্রাথমিকভাবে ভোজ্য তেল ও চিনিকে এই প্রথার আওতায় এনে সময় সময় এ দুটি পণ্যের দামও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
তবে সব জায়গায় এ প্রথা কার্যকর করা যায়নি। গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও মিলমালিকরা মিলে চিনি ও ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনির সর্বোচ্চ দাম হবে ৬৫ টাকা, খোলা সয়াবিনের দাম প্রতি লিটার ১০৯ টাকা ও খোলা পাম অয়েলের লিটার সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা। কিন্তু রোজার ঈদের আগে এর চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হয়েছে।
এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকিদল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলের খুচরা বাজারে কিছু জরিমানা আদায় করেছে। তবে আইনের আওতায় গঠিত জেলা ও উপজেলাপর্যায়ের কমিটিগুলোর তদারকির দুর্বলতার কারণে সারা দেশে এ প্রথার প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। তদারকির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত সেলেরও জনবল ও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
জানা যায়, জেলা ও উপজেলা কমিটি প্রতি মাসে একবার বৈঠক করে তার প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলকে পাঠানোর কথা। কিন্তু দুয়েকটি বাদে বাকি জেলা ও উপজেলা কমিটি প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে না। তারা বাজারও পর্যবেক্ষণ করছে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার দৃষ্টিতে পরিবেশক প্রথা এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা রয়ে গেছে।'
দুর্বল মনিটরিং সেল : পরিবেশক প্রথায় সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য ট্যারিফ কমিশনে গঠন করা হয়েছে একটি মনিটরিং সেল। ওই সেলের জনবল মাত্র পাঁচজন, আইনে বাধাধরা দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যা খুবই অপ্রতুল বলে মনে করেন সেলের কর্মীরা। সেলের জন্য কোনো বাজেটও নেই সরকারের। যানবাহনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণও পান না সেলের কর্মীরা। এমনকি সেখানে একটি ফ্যাঙ্ যন্ত্রও নেই। রয়টার্সের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারদর দেখার জন্য কনফিগারেশন যুক্ত একটি কম্পিউটারও প্রয়োজন।
মনিটরিং সেলে বিভিন্ন কম্পানির পরিবেশকরা অনেক অভিযোগ করেন। ওইসব অভিযোগ মনিটরিং সেলের কারা গ্রহণ করবেন, নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া কী হবে, তা নির্দিষ্ট হয়নি। ফলে অভিযোগগুলো অভিযোগ আকারেই পড়ে থাকছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় মনিটরিং কমিটি যেসব সিদ্ধান্ত নেয়, সেগুলো পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে কি-না, তা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে মাসিক প্রতিবেদন তৈরি করা সেলের কাজ। এ ছাড়া তাদের মূল্য ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পরিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন সময়ে প্রচারণার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। এতসব দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব উপকরণ ও অর্থ প্রয়োজন, তাও দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, মনিটরিং সেলের গাড়িসহ অন্যান্য উপকরণ কেনার জন্য ৬৭ লাখ টাকার একটি বাজেট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। আবার সেলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বছরে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল, তাও দেওয়া হয়নি।
মনিটরিং সেলের জনবলকে পর্যাপ্ত বলছেন না ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, 'আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে যেটুকু সম্ভব, তা আমরা করছি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল নিয়োগ হলে, প্রতিযোগিতা আইনের অধীন কম্পিটিশন কমিশন হলে আমাদের ওপর চাপ কমবে। কারণ মনিটরিং সেলের কাজের অনেকাংশ করবে ওই দুটি সংস্থা। এ দুটি কাজ হয়ে গেলে আমরা দেখব মনিটরিং সেলের ওপর কতটুকু জোর দিতে হয়। তখন তার ব্যবস্থা করা হবে।'
অনেক বাজারে পরিবেশক নেই : রাজধানীর বঙ্গবাজারের পাশের আনন্দবাজারে কোনো কম্পানির পরিবেশক নেই বলে দাবি করেছেন ওই বাজারের খুচরা বিক্রেতারা। তাঁরা জানান, পরিবেশক না থাকায় তাঁদের চিনি আনতে যেতে হয় মৌলভীবাজার। ৫০ কেজির এক বস্তা চিনি কিনতে তাঁদের পরিবহন খরচ যায় ৫০ টাকার কাছাকাছি। আর খুচরা বিক্রি করলে ঘাটতি হয় প্রায় আধা কেজি। এতে খরচ হয় ২৫ টাকার কাছাকাছি। ফলে পরিবেশক প্রথায় তাঁদের লাভের জন্য রাখা ৭৫ টাকা খরচ হয়ে যায় পরিবহন খরচ ও ঘাটতি বাবদ।
নাম প্রকাশ না করে ওই বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা বলেন, সরকার চিনির দাম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ার পর দীর্ঘদিন বাজারের কেউ চিনি বিক্রি করেননি। কারণ সরকার কেজিপ্রতি দেড় টাকা লাভ ঠিক করে দিয়েছিল। ওই লাভে বিক্রি করা সম্ভব হয় না। নির্ধারিত দামে না বিক্রি করলে সরকার জরিমানা করে। উল্লেখ্য, রোজার ঈদের আগে সরকার চিনির দাম কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা পরিবেশকদের কাছ থেকে ৬৩ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনতে পারতেন।
আনন্দবাজারের মতো ঢাকার অনেক ছোট বাজারে পরিবেশক নেই। শহরাঞ্চলের বাইরের অবস্থা আরো খারাপ। অক্টোবর মাসের হিসাব অনুসারে ভোজ্য তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে কম্পানিগুলোর মোট নিয়োগ দেওয়া পরিবেশকের সংখ্যা মাত্র সাত হাজার ৮৭ জন। আর চিনির ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছয় হাজার ১৫৮ জন। এত কমসংখ্যক পরিবেশক দিয়ে পুরো দেশকে আওতায় আনা যাচ্ছে না।
পরিবেশক না থাকায় লাভ বেঁধে দিয়ে নির্ধারিত দর কার্যকর করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, 'পরিবেশকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এটার ওপরে আরেকটু জোর দিতে হবে।'
আবার পরিবেশকদের জন্য কমিশন সমান হওয়ায় দূরের জেলাগুলোর পরিবেশকরা পণ্য বিক্রিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। চিনি বিক্রিতে একজন পরিবেশক কেজিপ্রতি দুই টাকা কমিশন পান। নারায়ণগঞ্জে যে পরিবেশক পণ্য বিক্রি করেন, তাঁর খরচ আর পঞ্চগড়ে যে পরিবেশক পণ্য বিক্রি করেন_তাঁর খরচে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পঞ্চগড়ের পরিবেশককে অনেক বেশি পরিবহন খরচ দিতে হয়। তাঁর পক্ষে দুই টাকা লাভে পণ্য বিক্রি করা কঠিন। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় কম্পানিগুলোর আঞ্চলিক সরবরাহ অফিস খোলার কথা উঠেছিল। কিন্তু তখন কম্পানিগুলো জানিয়েছিল, আঞ্চলিক অফিস খোলা হলে তাদের ওই অফিস থেকে সরবরাহ করা পণ্যের জন্যও ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের একই পণ্যের ক্ষেত্রে দুবার ভ্যাট দিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আঞ্চলিক অফিসের কাছ থেকে ভ্যাট না দেওয়ার নির্দেশ দিলে সমস্যার সমাধান হতো।
ভারত থেকে চিনি আমদানি করে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পরিবেশক ছাড়াই তা বাজারে বিক্রি করছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবেশকই নেই। আইন অনুযায়ী, পরিবেশক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান চিনি ও ভোজ্য তেল বিক্রি করতে পারবে না। ভারতের চিনির কারণে দাম কমে যাওয়ায় সরকার তখন পরিবেশক প্রথার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
খোলা পণ্য কমছে না : পরিবেশক প্রথার আইনে না বলা হলেও প্রথাটি চালুর সময় বলা হয়েছিল আস্তে আস্তে খোলা পণ্য তুলে নেওয়া হবে। ছোট ছোট প্যাকেটে পণ্য বাজারজাত করা হবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলা পণ্য আর প্যাকেটজাত পণ্যের অনুপাত আগের মতোই আছে। কোনো কম্পানি এখনো ছোট আকারের প্যাকেটে পণ্য বাজারজাত শুরু করেনি। এ নিয়ে প্রতিটি সভায় সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা দেওয়া হলেও মালিকদের সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি।
খোলা অবস্থায় পণ্য বিক্রি হওয়ায় কোন কোন পণ্য কোন কম্পানির, তা নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। ফলে কোনো কম্পানি বাজারে দুয়েক টাকা কম দামে পণ্য বিক্রি করলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। কারণ খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে সব পণ্যের দামই এক হয়ে যাচ্ছে। আর সেটা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ মূল্যে। যেমন_বর্তমানে একটি বড় কম্পানি সয়াবিন তেল মিলগেটে বিক্রি করছে লিটারপ্রতি ১০৩ টাকা দরে। আর আরেকটি বড় কম্পানি সেটা বিক্রি করছে ১০৫ টাকা দরে। কিন্তু কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রেতারা কেজিপ্রতি ১২০ টাকা দরে বিক্রি করছেন_কেনা ১০৩ টাকা হোক আর ১০৫ টাকা হোক। প্যাকেটজাত হলে এ সমস্যা হতো না বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

No comments

Powered by Blogger.