টঙ্গী-পোস্তগোলা সাড়ে ৩৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়কঃ সুফল আটকে দিল ফলের বাজার by আনোয়ার হোসেন ও ইকবাল হোসেন

০০ মিটার সংযোগ সড়কের অভাবে এবং সড়কের ওপর দুটি বাজারের কারণে রাজধানীকে ঘিরে নির্মিত সাড়ে ৩৪ কিলোমিটার সড়ক পুরোপুরি ব্যবহূত হচ্ছে না। টঙ্গী থেকে পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত বেড়িবাঁধের ওপর এই সড়কটি নির্মিত হয়েছিল ঢাকার ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে। কিন্তু বাদামতলী ঘাটসংলগ্ন সড়কের ওপর বসা ফলের বাজার যানবাহন চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। এর কিছুদূর পর সড়কে বসে সবজির বাজার।

এ কারণে টঙ্গী থেকে মিরপুর মাজার রোড এবং আমিনবাজার থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত ভেঙে ভেঙে কিছু যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্র জানায়, টঙ্গী থেকে শুরু হয়ে সড়কটি শেষ হয়েছে পোস্তগোলা সেতুর কাছে। টঙ্গী থেকে মাজার রোড হয়ে গাবতলী পর্যন্ত দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। মাজার রোড থেকে গাবতলী (আমিনবাজার) পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশে ১০০ মিটার সংযোগ সড়ক না থাকায় টঙ্গী থেকে আমিনবাজার বা সোয়ারীঘাট পর্যন্ত সরাসরি যান চলে না। টঙ্গী থেকে বাস বা টেম্পোতে মাজার রোডে নামতে হয়। সেখান থেকে আবার বাস বা টেম্পোতে আমিনবাজারে গিয়ে তারপর সোয়ারীঘাটের উদ্দেশে যানবাহনে উঠতে হয়। আমিনবাজার থেকে সোয়ারীঘাট ১৯ কিলোমিটার।
আমিনবাজার থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত যানজাবিল ও ব্রাদার্স পরিবহনের প্রায় ৫০টি বাস চলাচল করে। পরিবহন শ্রমিকেরা জানান, দুই বছর আগে হানিফ পরিবহনের বাসও চলত। সড়কের দুরবস্থার কারণে ওই বাস বন্ধ হয়ে গেছে। লালবাগ কেল্লার মোড় থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়ক ভাঙা, খানাখন্দে ভরা। সড়কের অংশবিশেষ দখলও হয়ে গেছে।
সোয়ারীঘাট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার। কিন্তু সোয়ারীঘাটের সামান্য দূরে বাদামতলী ঘাটসংলগ্ন ফলের এবং শ্যামবাজারে সবজির বাজার ও ভাগাড়ের কারণে এরপর যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
সড়কের এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে নারায়ণগঞ্জ, পোস্তগোলা, সদরঘাটসহ আশপাশের এলাকা এবং গাবতলী, টঙ্গী, মিরপুরের মধ্যে চলাচলে যানবাহনগুলো শহরের সড়ক এড়াতে পারত। এতে শহরের সড়কে চাপ কমত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটি তিনি দেখেছেন এবং এটিকে কার্যকর রিং রোড হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। দুনিয়াজুড়ে রিং রোড সাধারণ সড়কের চেয়ে বেশি কার্যকর। সড়কটি ব্যবহারের উপযোগী করা গেলে নগরে যানবাহনের চাপ কমবে এবং মানুষের যাতায়াতও সহজ হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কটির আমিনবাজার থেকে বাদামতলী পর্যন্ত প্রায় ৫০টি বাস ছাড়াও কাভার্ড ভ্যান, মিনি ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো ও গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে সোয়ারীঘাট, চম্পাতলী, ছোট কাটরা, ইমামগঞ্জ, পানঘাট, রাজাকারঘাট, দেবীদাস ঘাট ও মিটফোর্ড এলাকার ৭০-৭৫টি ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানও রয়েছে। তবে সড়কের কেল্লার মোড় থেকে বাদামতলী পর্যন্ত অংশ ব্যাপক ভাঙা ও খানাখন্দে ভরা।
এই পথে চলাচলকারী যানবাহনের কয়েকজন চালক ও যাত্রী জানান, বর্ষাকালে এই অংশ ব্যবহারের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ব্রাদার্স পরিবহনের ব্যবস্থাপক বলেন, এই সড়কে একবার বাস চালানোর পরই তা মেরামতের জন্য নিতে হয়। অথচ এর পরও এই পথে অনেক যাত্রী।
ছোট কাটরার সুবর্ণা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম বলেন, সড়কের দুরবস্থার কারণে চালকেরা ট্রাক চালাতে চান না।
নগরের যানজটে পড়ার দুর্ভোগ এড়াতে ও সময় বাঁচাতে সদরঘাট থেকে গাবতলী আসতে এই সড়ক ব্যবহার করা মুন্সিগঞ্জের অরিন্দম পাল বলেন, তিনি নিয়মিত মানিকগঞ্জে যাতায়াত করেন। সদরঘাট থেকে বাসে শহরের ভেতর দিয়ে গাবতলী যেতে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টাও লাগে। অথচ বেড়িবাঁধ দিয়ে গেলে লাগে দুই ঘণ্টা।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাদামতলী ঘাটসংলগ্ন সড়কে ফলবোঝাই প্রায় ৫০টি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি ট্রাকের সঙ্গে কয়েকটি রিকশাভ্যান। তাই সড়কে যান চলাচলের সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, ভোর ছয়টা থেকে সারা দিনই এখানে ট্রাক থেকে ফল বেচাকেনা হয়। ক্রেতারা ফল কিনে সেখানেই কার্টনে ভরে মিনি ট্রাক ও ভ্যানে করে নিয়ে যান।
এর কিছু দূরে লালকুঠি ঘাট থেকে ফরাশগঞ্জ সেতু পর্যন্ত সড়কের দুই পাশেই সবজির দোকান। শ্যামবাজার নামে পরিচিত এ এলাকায় এসব দোকানের কারণে সড়কটিতে রিকশাভ্যানও চলতে পারে না। এখানে বিকিকিনি শুরু হয় ভোররাত চারটায়, চলে একটানা দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এরপর তিন ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়ে চলে রাত অবধি।
শ্যামবাজারের আশপাশের রিকশাচালক মো. শহিদুল বলেন, আগে বিরতির সময় ওই সড়কে রিকশাভ্যান চলাচলের অনুমতি ছিল। মাস চারেক ধরে ফরাশগঞ্জ সেতুর কাছের সড়কে বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভাগাড় করায় রিকশাভ্যান চলাচলও বন্ধ।
শ্যামবাজার কৃষিপণ্য বণিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মহসীন উদ্দিন বলেন, রাস্তায় বাজার বসানোর বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনুমোদন আছে। বাজারের কারণে নয়, যানবাহন চলে না সড়ক ভাঙাচোরা বলে। ভাগাড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাকই ময়লা-আবর্জনা ফেলে।
রাজধানীকে ঘিরে তৈরি করা বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ২০০০ সালের দিকে সড়ক নির্মাণ করা হয়। সড়কটি যৌথভাবে নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। ২০০১ সালে সড়কটির নিয়ন্ত্রণ পায় সওজ।
সড়কের অংশবিশেষ দখল: লালবাগের পশ্চিম ইসলামপুর বাগানবাড়ী থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত সড়কের অংশবিশেষ চলে গেছে কয়েকটি বাড়ির দখলে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সড়ক দখলমুক্ত করা হলেও আবারও দখল হয়ে গেছে।
পোস্তগোলা এলাকায় সড়কটি ব্যবহার না হওয়ায় চলে গেছে স্টিলের শিটের দোকানের দখলে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধটি তাঁদের, কিন্তু সড়কটি সওজকে দেওয়া হয়েছে। সে জন্যই তাঁরা আর রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না।
সওজের ঢাকা বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, সড়কের টঙ্গী থেকে শিন্নিরটেক পর্যন্ত অংশ পুরো ব্যবহার করা যাচ্ছে না সামান্য সংযোগ সড়কের অভাবে। সংযোগ সড়ক করার জন্য ৮০ কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। আমিনবাজার থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত সড়ক মেরামত ও প্রশস্ত করতে ৭১ কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। কিন্তু এই অর্থবছরে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ায় পুরোদমে কাজ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সড়কের সোয়ারীঘাট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত অংশ তাঁরা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না। এই অংশের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সড়ক থেকে বাজার, অবৈধ দখল উচ্ছেদে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত দরকার।

No comments

Powered by Blogger.