লৌহমানব লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত

২ বছর দেশ শাসনের পর গত ফেব্রুয়ারিতে টলে ওঠে লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির গদি। তবে পিছু না হটে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি যোদ্ধা, লড়তে লড়তে যুদ্ধক্ষেত্রেই মরতে চাই।’ প্রতিরোধরত অবস্থায়ই গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত হলেন লিবিয়ার লৌহমানব গাদ্দাফি। লিবিয়ার জাতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ (এনটিসি) জানিয়েছে, গাদ্দাফিকে তাঁর জন্মস্থান সিরত শহর থেকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়। এরপর তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে আটক অবস্থায় কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো, তা কোনো পক্ষই নিশ্চিত করে জানায়নি।

গাদ্দাফির নিহত হওয়ার সময়কার যে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে গাদ্দাফির ছেলে মুতাসিমের মৃত্যুর ঘোষণায়। এনটিসি গতকাল একই সঙ্গে দাবি করেছে, গাদ্দাফির সঙ্গে ছেলে মুতাসিমও নিহত হয়েছেন। কিন্তু গত ১৪ অক্টোবর এনটিসির অন্তর্ভুক্ত ত্রিপোলি রেভল্যুশনারি কাউন্সিল (টিআরসি) বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছিল, মুতাসিমকে সিরত থেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনগাজিতে নেওয়া হয়েছে। ফলে সিরত শহরে গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলের একই সঙ্গে মৃত্যুর সময়কার যে পরিস্থিতি এনটিসি বর্ণনা করছে, তা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
গত ২৩ আগস্ট লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির চূড়ান্ত পতনের পর গাদ্দাফির অনুগত যোদ্ধারা তাঁর জন্ম শহর সিরতসহ কয়েকটি শহরে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। গতকাল গাদ্দাফির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সিরতেরও পতন হয়েছে বলে দাবি করেছে এনটিসি।
তবে গতকাল এনটিসির ঘোষণার আগেই বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গাদ্দাফির রক্তাক্ত ছবি ও ভিডিওচিত্র। কোনো এক এনটিসি যোদ্ধার মুঠোফোনে ধারণ করা ওই ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, গাদ্দাফিকে জীবিত আটক করা হয়। এ সময় তাঁর মাথা, মুখমণ্ডল ও ঘাড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। তিনি হাঁটার চেষ্টা করছেন আর তাঁকে টানাহেঁচড়া ও বিদ্রূপ করছেন এনটিসি যোদ্ধারা। একপর্যায়ে তাঁকে টেনে তোলা হয় একটি গাড়ির সামনের বনেটের ওপর। সেখানে থেকেও তাঁকে আবার টেনেহিঁচড়ে নামানো হয়। একজন গাদ্দাফির মাথা বরাবর বন্দুক তাক করে ধরেন। ওই ব্যক্তি তাঁকে তখনই গুলি করেছেন কি না, তা ভিডিওতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বিবিসি, আল আরাবিয়া ও আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন টেলিভিশন এই ভিডিওচিত্র প্রচার করে।
আল-জাজিরা টেলিভিশনের খবরে দেখা যায়, এক ব্যক্তি নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে বলেছেন, স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেউ একজন নাইন এমএম আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গাদ্দাফির পেটে গুলি করেছেন।
গাদ্দাফি ঠিক কীভাবে নিহত হলেন, তা নিয়ে এনটিসি কমান্ডার ও যোদ্ধারাই দুই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন। একটি ভাষ্য, ন্যাটো বাহিনীর বিমান হামলায় আহত হয়ে পরে মারা গেছেন গাদ্দাফি। এনটিসি বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবদেল মজিদ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার খুব সকালের দিকে একটি গাড়িবহর নিয়ে গাদ্দাফি সিরত শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ওই গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ন্যাটো।’
আবদেল মজিদ পরে বলেন, ‘গাদ্দাফি মারা গেছেন। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন।’
সিরত শহরে বিমান হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ন্যাটো। তারা বলেছে, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটার দিকে ওই বিমান হামলা চালানো হয়।
দ্বিতীয় ভাষ্য এমন—এনটিসি যোদ্ধাদের একটি অংশ বলছে, তারাই গাদ্দাফিকে খুঁজে বের করে। তিনি শহরের রাস্তার একটি কালভার্টের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে টেনে বের করা হয়। তখন গাদ্দাফি বারবার বলছিলেন, ‘গুলি কোরো না, গুলি কোরো না।’
এনটিসির প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল গতকাল সন্ধ্যায় ত্রিপোলিতে এক সংবাদ সম্মেলনে গাদ্দাফির নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। জিবরিল বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করছি, গাদ্দাফিসহ সব অশুভ শক্তি আমাদের প্রিয় দেশের মাটি থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশবাসীকে এটা উপলব্ধি করা দরকার, নতুন লিবিয়া গড়ে তোলার সময় এসেছে।’
এর আগে এনটিসির মুখপাত্র আবদেল হাফিজ ঘোগা বলেন, ‘আমরা বিশ্বকে জানাচ্ছি, বিপ্লবীদের হাতে গাদ্দাফি নিহত হয়েছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। গাদ্দাফির নিয়তি যা ছিল, তা-ই ঘটেছে।’
সিরত শহরের চিকিৎসক আবদু রউফ জানান, লড়াইয়ে গাদ্দাফি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউনুস নিহত হয়েছেন। তাঁর লাশ একটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সেখানেই লাশটি আবু বকর ইউনুসের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এনটিসি বাহিনীর ১১তম ব্রিগেডের কমান্ডার আবদুল হাকিম আল জলিল বলেন, ‘প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউনুসের লাশ আমি নিজে দেখেছি।’ এ ছাড়া গাদ্দাফি সরকারের সাবেক মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিমকেও আটক করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমুল লড়াই চলছিল সিরত শহরে। গতকাল এনটিসি দাবি করেছে, ওই শহর এখন পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে। গত আগস্টে ত্রিপোলি পতনের পর থেকে গাদ্দাফির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। এর পর থেকে এনটিসির মূল লক্ষ্য ছিল গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি সিরত।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জিবরিল বলেন, গাদ্দাফির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছেলে সাইফ আল ইসলামের খোঁজ পাওয়া গেছে বলে অসমর্থিত খবরে তিনি জানতে পেরেছেন। সিরত শহরের কাছে সাইফের গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
পরে এনটিসির বিচারমন্ত্রী জানান, সাইফ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ত্রিপোলি থেকে বিবিসির সাংবাদিক ক্যারোলিন হাওলি জানান, ত্রিপোলিতে যানবাহনের হর্ন বাজিয়ে, আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করছে লোকজন। তারা একে অন্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
কিন্তু গাদ্দাফিপন্থী টেলিভিশন আল-লিবিয়ার ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, ‘গাদ্দাফিকে আটক বা হত্যার দাবি করে ন্যাটোর তাঁবেদাররা যে খবর দিচ্ছে, তা ভিত্তিহীন। গাদ্দাফি সুস্থ আছেন।’
সিরত শহরের পুরো অংশ এনটিসি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে দাবি করে বাহিনীর কর্নেল ইউনুস আল আবদালি বলেন, ‘সিরত এখন স্বাধীন। কোথাও গাদ্দাফির বাহিনী নেই। এখন আমরা তাঁর যোদ্ধাদের খুঁজে ফিরছি।’
১৯৬৯ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ক্রমে সমাজতন্ত্র ও ইসলামি আদর্শের মিশেলে এক নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে তোলেন তিনি। টানা ৪২ বছর দেশ শাসন করেন গাদ্দাফি। চলতি বছরের প্রথম দিকে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়ায়ও সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কয়েক মাসের আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের পর অবশেষে গত ২৩ আগস্ট ত্রিপোলির পতন ঘটে। এরপর আত্মগোপনে চলে যান ৬৯ বছর বয়সী গাদ্দাফি।
এর আগে গত ২৮ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসি গাদ্দাফি, তাঁর ছেলে এবং গোয়েন্দাপ্রধানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ জানিয়েছে, গাদ্দাফির লাশ মিসরাতা শহরে নিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ছেলের লাশের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি। সূত্র: এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা।

No comments

Powered by Blogger.