সব দুশ্চিন্তা তো ক্যারিবীয় বোলিং আক্রমণ নিয়ে by নোমান মোহাম্মদ,

টোয়েন্টি-টোয়েন্টিতে ২৪ বলে ২৩, এরপর দুটো ওয়ানডেতে ১২৪ বলে ১২২ এবং ১২৫ বলে ৮০_বাংলাদেশের বোলারদের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন ওপেনার লেন্ডল সিমন্স। ইনজুরির কারণে শেষ ওয়ানডে খেলেননি, আর টেস্ট স্কোয়াডেও ছিলেন না। স্বাগতিকদের তাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবার উপলক্ষ ছিল। কিন্তু সেটি আর হলো কই! আরেক ওপেনার আদ্রিয়ান বারাথ ইনজুরির কারণে টেস্ট সিরিজ থেকে ছিটকে যাওয়ায় সেখানে ঢুকে পড়েছেন সিমন্স। তাঁর রান-উৎসব মাটি করার চ্যালেঞ্জ তাই বাংলাদেশের সামনে।


কিন্তু বিশ্বাস করুন, সিমন্সকে নিয়ে বাংলাদেশ ততটা চিন্তিত নয়, যতটা চিন্তিত ক্যারিবীয় বোলিং আক্রমণ নিয়ে। এমনিতেই স্বাগতিকদের টপ অর্ডার ব্যাটিংটা নড়বড়ে। সামান্য হাওয়াতেই তা উড়ে যায় তাসের ঘরের মতো। সেখানে ক্যারিবীয় টেস্ট বোলিং লাইন যে রীতিমতো টর্নেডো! ফিদেল এডওয়ার্ডস, কেমার রোচ ও রবি রামপালের ত্রিশূলে তিন জেনুইন ফাস্ট বোলার। সঙ্গে ড্যারেন স্যামির নিয়ন্ত্রিত-কার্যকর পেস। এখানে শেষ হলেও হতো। দেবেন্দ বিশু আছেন না! টেস্ট ম্যাচ জেতানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্র লেগ স্পিনের জাদু নিয়ে। ক্যারিবীয় অধিনায়কের জন্য এর চেয়ে স্বপ্নের আক্রমণ তো আর হতে পারে না।
বাংলাদেশের জন্য সেটিই আবার বিভীষিকার। হবে না? গড়পড়তা বোলিং আক্রমণের বিপক্ষেই তো টেস্টে খাবি খায় ব্যাটসম্যানরা। ২০০৯ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১১টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে, ইংল্যান্ড, ভারত, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা সেই টেস্টগুলোর কোনোটিরই বোলিং আক্রমণ কাগজ-কলমে অন্তত এতটা ভীতি ছড়ায়নি। জিম্বাবুয়েতে খেলেছে তারা ভিটোরি-জার্ভিস-পোফু-চিগুম্বুরার পেসের সঙ্গে প্রাইসের স্পিন। ইংলিশ বোলিং আক্রমণে সামলেছে ব্রড-ব্রেসনান-ফিন-সোয়ানদের। তেমনি ভারতের জহির-ইশান্ত-ওঝা কিংবা নিউজিল্যান্ডের মার্টিন-সাউদি-টাফি-ভেট্টোরি, কোনো বোলিং আক্রমণই তো একেবারে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো না। কিন্তু বাংলাদেশ তো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে প্রায় প্রতিবারই।
ব্যতিক্রম হয়ে আছে ২০০৯ সালে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সিরিজ। কোন প্রেক্ষাপটে তা হয়েছিল, সেখানে কারা খেলেছিলেন, সেটি নিয়ে আলোচনা অবান্তর। তবে এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে বোলিংয়ের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ, কাগজ-কলমের হিসাবে সেটি দুর্দান্ত। ৯০ মাইল গতিতে পাঁজর বরাবর ধেয়ে আসা বল যেমন সামাল দিতে হবে, তেমনি আবার লেগ স্পিনের মায়াবী বিভ্রম কাটানোর চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে জয়-পরাজয়েই যে টেস্টের গতিপথ নির্ধারিত হবে, সে আর বলতে!
ফাস্ট বোলিংয়ের নেতৃত্বে থাকবেন যিনি, সেই এডওয়ার্ডস কাল খালি গায়ে ইনডোরে ঘাম ঝরালেন অনেকক্ষণ। বাউন্সার-ইয়র্কারের যুগল প্রদর্শনী ছিল তা। ৪৬ টেস্টে ১৪১ উইকেট নিয়েছেন তিনি ৩৬.৮১ গড় এবং ৫৬.৩ স্ট্রাইকরেটে। ইনিংসে এডওয়ার্ডের পাঁচ উইকেট আছে ১০ বার। আরেক ফাস্ট বোলার কেমার রোচ বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই বিদ্রোহী সিরিজে ক্যারিবিয়ানদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে ৬ উইকেট, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আরো ছয়টি_স্বপ্নের মতো শুরু যাকে বলে আর কী! ক্যারিয়ারের ১২ টেস্টে ২৯.৯০ গড় এবং ৫৭.৩ স্ট্রাইকরেটে ৪০ উইকেট নিয়েছেন রোচ। রবি রামপালের ১০ টেস্টে শিকার ২৫ ব্যাটসম্যান। আর স্যামি ১৬ টেস্টে নিয়েছেন ৪৬ উইকেট। যার মধ্যে আছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যানচেস্টারে ৭ উইকেটে নেওয়াও। লেগ স্পিনার বিশুর ক্যারিয়ার শুরু হলো মাত্র। ৫ টেস্টে তিনি ২১ উইকেট নিয়েছেন ৩৫.৪২ গড় এবং ৬৮.৪ স্ট্রাইকরেটে।
পরিসংখ্যান দেখে তাদের বিধ্বংসী ক্ষমতার সবটা হয়তো বোঝা যায় না। তবে তাদের সামর্থ্যের প্রতিফলন মাঠে থাকলে এটি তো বিশ্বসেরা বোলিং আক্রমণ হওয়ার দাবিদার! সমস্যাটা হচ্ছে বড্ড অধারাবাহিক তারা। কিন্তু কে জানে, এই দুই টেস্টেই না তাঁরা ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠেন। সেই সামর্থ্য যে তাঁদের আছে, এ নিয়ে সংশয়ের সুযোগ সামান্য।
বাংলাদেশের কোচ স্টুয়ার্ট ল'কে তাই অনেকক্ষণ কাজ করতে দেখা গেল ব্যাটসম্যানদের নিয়ে। বিশেষত যুদ্ধক্ষেত্রে ফাস্ট বোলিংয়ের মোকাবিলা করার জন্য সৈনিকদের তৈরি করছিলেন তিনি। আর সেটি পারবেন বলে আশাবাদও শুনিয়ে গেলেন ল, 'উপমহাদেশের বাইরের দলগুলোর বোলারদের শারীরিক গঠন অন্য রকম। তারা অনেক লম্বা এবং শক্তিশালী। কন্ডিশন যেমনই হোক, পাঁজর বরাবর ৯০ মাইল গতিতে বোলিং করতে পারে তারা। সেগুলোর মুখোমুখি হতে কেউই পছন্দ করে না। তবে এর বিপক্ষে খেলেই আমাদের রান করার একটা উপায় বের করতে হবে।' প্রধান নির্বাচক আকরাম খানও শোনালেন সেই আশার গান, 'ওদের বোলিং আক্রমণ খুবই ভালো। বিশেষত টেস্টের জন্য। ওদের বোলাররা অনেক জোরে বোলিং করে। আর টেস্টে একজন লেগ স্পিনার তো সব সময়ই অধিনায়কের বড় সম্পদ। তবে ব্যাটসম্যানদের ওপর আমার আস্থা আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই বোলিং আক্রমণ সামলেও ভালো করার সামর্থ্য আমাদের আছে। ক্রিজে গিয়ে সেটি প্রয়োগ করতে পারলেই হয়।'
পারলে তো হয়, কিন্তু বাংলাদেশ পারবে কী? সংশয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে টপ অর্ডারকে ঘিরে। নইলে হয়তো কালকের মতো স্টুয়ার্ট ল'কে আরো অনেক দিন বলতে হবে, 'টেস্ট থেকে বাংলাদেশের যতটা অর্জন করার ছিল, সেটি পারেনি।' আর তাঁর পরের কথা জোগাবে কৌতুকের খোরাক, 'আমরা যদি ভালো ক্রিকেট খেলি, প্রাপ্ত সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আমি নিশ্চিত বিশ্বের যে কোনো দলের সঙ্গে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারব। আমার মনে হচ্ছে, বড় বড় সেঞ্চুরি করা থেকে ব্যাটসম্যানরা খুব দূরে নেই।'
দেখা যাক, এডওয়ার্ডস-রোচ-রামপাল-স্যামি-বিশুদের ওই বিস্ফোরক বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ওই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে কি না বাংলাদেশ। যাবতীয় প্রতিকূলতা আর দুর্ভাবনার অন্ধকূপ থেকেই যে মাথা তুলে দাঁড়ায় বাংলাদেশ!

No comments

Powered by Blogger.