তোপের মুখে পিপিপি সরকার by আই এ রেহমান



ইসলামাবাদে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির যখন ধর্মোন্মাদনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য জীবন দিচ্ছেন, তখন লাহোরে মুসলিম লিগের নেতা নওয়াজ শরিফ সেই দলের বিরুদ্ধে জোট গড়ছেন, যে দলের নেতার সঙ্গে কিছুদিন আগেই তিনি গণতন্ত্র সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন।
নতুন বছরের ৪ জানুয়ারির এই দুটি ঘটনার যোগফলই এখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যার জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে। ক্ষমতার দখল লাঠালাঠিতে ব্যস্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো কিন্তু জানে যে দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে সেসব চরমপন্থী, যারা তাদের তৈরি ব্যবস্থাসহ তাদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। একদিক থেকে অবস্থাটা হয়েছে বাগদাদের গরিমাময় ইসলামি সাম্রাজ্যের ধ্বংসের আগের অবস্থার মতো। মোঙ্গল যাযাবরেরা যখন সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসছে, তখন শহরের বিজ্ঞ মোল্লারা ব্যস্ত ছিলেন একটি সুচের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উট পার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তা নিয়ে।
পাকিস্তানের সংকটের পরিমাপ সালমান তাসিরের হত্যার বিরুদ্ধে ধর্মীয় দলগুলোর নিন্দা জানানোর অস্বীকৃতি দিয়েই শুধু নয়, সরকারি জোটের পতনের লক্ষ্যে মুসলিম লিগের (নওয়াজ) নেতার জোর প্রচেষ্টা দিয়েও করা যায়। মুসলিম লিগ পাঞ্জাব সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলেছে। একই সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। (পরে অবশ্য এই সময়সীমা ছয় দিনে বাড়ানো হয়)। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সরকারি দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে (পিপিপি) পাঞ্জাবের ক্ষমতা ছাড়তে হবে বলে হুঁশিয়ারি করেছেন তিনি। বাস্তবত তাঁর দাবি কেউ পূরণ করবে না জেনেও তিনি নিরস্ত হননি।
কিন্তু মাঝখানের এই কদিনে কী এমন ঘটল, যাতে নওয়াজ শরিফ অবস্থান বদলালেন? নিশ্চিতভাবেই দলের কট্টরপন্থীরা তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তাদের মরিয়াপনা লুকিয়ে তারা বোঝার চেষ্টা করছে সরকারি জোটকে সমর্থন করায় তাদের দলীয় সমর্থন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া পিপিপির সঙ্গে পিএমএলের (কিউ) জোট গড়ার প্রস্তুতিও তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। অথবা আগামী মার্চে গিলানি সরকারের পতন হওয়ার গুজবে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউ- এম), জামায়া উলামায়ে ইসলাম ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) বাজি রেখে দেখতে চাইছে, কোনো লাভ হয় কি না।
অথচ নওয়াজ শরিফের উচিত ছিল গণতন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়ের মধ্যে দলের ভোট বাড়ানোয় কাজ করা। অন্য কিছু হওয়া মানে আগাম নির্বাচন, যা বেশির ভাগ দলই চায় না। অন্য বিকল্প হলো, মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সঙ্গে এমকিউএম ও জেইউইর কণ্টকাকীর্ণ ঐক্য।
এ অবস্থায় পিপিপির সামনে সুযোগ রয়েছে জোটের সমস্যাজনক শরিকদের থেকে কিছুটা মুক্ত হওয়ার। তা করলে তারা হারাবে সামান্যই, কিন্তু লাভবান হবে বেশি। পিপিপির জন্য সম্মানজনক হলো, কয়েক মাস পর পুরোপুরি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার চেয়ে বর্তমানে কিছুটা ক্ষমতা হারানো। তবে অনেকেই মনে করেন, পিপিপি নগদ লাভ ও সংকীর্ণ স্বার্থ ছাপিয়ে জনস্বার্থে রাজনীতি করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গল দেখতে অক্ষম।
সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাহীন সরকার যদি মেনে নেয় যে তাদের সেই সুবিধা থাকবে না, যা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকার উপভোগ করে, তাহলে হয়তো তারা প্রজ্ঞা, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে কেবল বিপর্যয় মোকাবিলাই নয়, জনসমর্থনের ভিত্তিও প্রসারিত করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী গিলানি জোটের সামনে এখন এ সুযোগটিই খোলা রয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, সরকারের পক্ষে আইন প্রণয়ন করায় সংসদে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। বিশেষত, সেসব প্রস্তাব নিয়ে সমস্যা হবে, যেগুলোর প্রভাব ব্যবসায়ী মহল ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর পড়বে। কিন্তু সরকার বিরোধীদের পরাস্ত না হোক, বিব্রত করতে পারে। ধরা যাক, কঠিন জবাবদিহিমূলক আইন অথবা ব্যাপকবিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। এসবের বিরোধিতা যে-ই করবে, তাকেই জনসমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। জনগণকে সরকারের পেছনে রাখতে হলে পিপিপিকে অবশ্যই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং গোপন কার্যকলাপ ও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অযোগ্যদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
একই সঙ্গে তাদের রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী বক্তব্য দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। যেমন—কিছুদিন আগে বলা হয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ থেকে জনগণকে রক্ষায় তারা কিছু করতে পারবে না। ব্যাপারটা এমন যে ডাকাতির শিকার ব্যক্তিকে বলা যে ডাকাত যেহেতু সরকারের কথা শোনে না, সেহেতু এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু সোজা সত্য হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাধা থাকা সত্ত্বেও সরকারকে অবশ্যই মজুরির তুলনায় জীবনযাত্রার মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ার শিকার জনগণের জন্য কিছু করতেই হবে।
তা ছাড়া এখনই সময়, প্রচলিত এ ধারণা ভেঙে দেওয়া যে পিপিপি সরকার অন্য যে কারও চেয়ে অনেক বেশি করে আইএমএফের বিধিনিষেধের অনুগত। প্রায়ই দেখা যায়, তারা আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের চাওয়ার চেয়েও বেশি সুবিধা দিতে ইচ্ছুক থাকে। এখানে অর্থনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে না; বরং বলা হচ্ছে, সরকার যেন জনগণকে রক্ষার ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার আরও জোরদার করে এবং জনস্বার্থ রক্ষায় আরও কার্যকর উপায়ও খুঁজে দেখে।
কারও পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে পাকিস্তানের সরকার গুরুতর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের সংহত করতে পারে না, তারা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও জাগাতে পারে না। তার পরও এখনো যেহেতু শেষ গুলিটি ফোটেনি, সেহেতু কিছু আশা রাখাই যায়।
আই এ রেহমান: পাকিস্তানের সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.