স্বাধীনতার মাস: মার্চ মাস by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এই মাসের ১৮ তারিখ সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। অনেক দিন থেকেই আমরা চাইছিলাম, তাঁরা এখানে আসেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা নিজের চোখে তাঁদের দেখবে, সেটি খুব কম কথা নয়। তাঁদের আসা উপলক্ষে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো উত্সবের একটা আমেজ চলে এসেছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সুন্দর একটা শহীদ মিনার রয়েছে, প্রায় শখানেক সিঁড়ি ভেঙে টিলার ওপরে ওই শহীদ মিনারে যেতে হয়। কষ্ট করে কেউ যদি সেখানে যায়, চারপাশের দৃশ্য আর শহীদ মিনারটি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যরা ওই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এগারোটি সেক্টরকে স্মরণ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাত দিয়ে এগারোটি গাছ লাগিয়ে রাখব, গাছগুলো যখন বড় হবে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা তার ছায়ায় বসে মুক্তিযোদ্ধাদের একবার হলেও স্মরণ করবে!
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যরা খুব উত্সাহ নিয়ে গাছগুলো লাগালেন। যিনি যেই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, তিনি সেই সেক্টরের গাছটি লাগলেন। (কার সেক্টরে কোন গাছটি পড়েছে, সেটি নিয়ে তাঁদের একধরনের ছেলেমানুষি আনন্দ হচ্ছিল, যেটি দেখে আমরাও খুব মজা পেয়েছিলাম।) আমরা গাছগুলো লাগিয়েছি বাংলাদেশের ম্যাপের সঙ্গে সাজিয়ে, কাজেই গাছগুলো দেখেই একজন বুঝতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন সেক্টরটি কোন অঞ্চলে ছিল।
গাছ লাগানো শেষ হওয়ার পর আমরা তাঁদের নিয়ে গেলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে। এটি হচ্ছে আমাদের লাইব্রেরির একটি কর্নার (আক্ষরিক অর্থেই এটি একটি কর্নার বা কোনা!), যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত প্রতিটি বই সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পতাকা, পোস্টার, ছবি দিয়ে এ কর্নারটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা বসে মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে পারে। এ কর্নারটি নিয়ে আমাদের ভেতরে খানিকটা ছেলেমানুষি অহংকার আছে, কেউ বেড়াতে এলেই আমরা তাকে সেখানে নিয়ে যাই। কাজেই সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যদেরও আমরা সেখানে নিয়ে গিয়েছি, তাঁদের ছবি তুলে রেখেছি, তাঁদের মন্তব্য কাগজে লিখিয়ে নিয়েছি। যখন আমরা কেউ থাকব না, তখনো তাঁদের ছবি কিংবা হাতের লেখা এখানে থাকবে—ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীরা সেটি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখবে।
এরপর আমাদের সত্যিকারের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আমাদের অডিটরিয়ামটি খুব ছোট। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যরা আসছেন বলে শহর থেকেও অনেকে চলে এসেছে, তাই অডিটরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল না।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্যরা বক্তব্য রাখলেন, প্রশ্নের উত্তর দিলেন, যারা উপস্থিত ছিল তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁদের কথা শুনল। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েছে, যাঁরা সেই ইতিহাসটি তৈরি করেছেন, তাঁদের মুখ থেকে সরাসরি ওই ইতিহাসের কথাগুলো শোনা শ্রোতাদের জন্য একটি অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কথার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের কথা মনে করিয়ে দিলেন, তাদের বিচার করে এই দেশকে গ্লানিমুুক্ত করার স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন।
তাঁরা সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই ফিরে গেলেন, পরদিন ছাত্রছাত্রীরা আমাদের কাছে ভিড় করে এল, যারা ছোট অডিটরিয়ামে ঢুকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেনি, তাদের খুব মন খারাপ, অনেকেই রীতিমতো ক্ষুব্ধ। আবার একটি আয়োজন করা হবে বলে তাদের কোনোভাবে শান্ত করা হলো। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে এ রকম গভীর মমতা দিয়ে গ্রহণ করেছে দেখে আমাদের খুব ভালো লাগে।

২.
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই গভীর মমতা, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য এই তীব্র ঘৃণা কি সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আছে? সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আগমন উপলক্ষে কিছু পোস্টার তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষা ভবন এবং হলগুলোয় টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পোস্টারে যুদ্ধাপরাধীর বিকট চেহারা এবং নাকের ডগায় একটা ফাঁসির দড়ি ঝুলছে, সে রকম একটি ছবির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশসংক্রান্ত কিছু কথা লেখা ছিল। পোস্টার লাগানোর পরদিন দেখা গেল, ছাত্রদের হলে লাগানো পোস্টারটি কে বা কারা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। যার অর্থ ছাত্রদের এই হলে এমন কিছু ছাত্র আছে, যাদের কাছে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ছাত্রগুলো কারা, সেটা অনুমান করার জন্য কারও রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করে ছাত্রগুলো হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা থাকে, আমি আলাদা করে তাদের কাউকেই চিনি না, কিন্তু আমি তাদের জন্য সব সময়েই একধরনের করুণা অনুভব করি। আমার কাছে মনে হয়, ছাত্রশিবিরের সদস্যরা হচ্ছে এ দেশের সবচেয়ে দুর্ভাগা শ্রেণী।
ছাত্রজীবনটা হচ্ছে স্বপ্ন দেখার সময়। এটি এমন একটি বয়স, যখন সবকিছুকেই রঙিন মনে হয়। এ সময়টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি এক শ ধরনের কাজকর্ম করে। তারা গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে, নাটক করে, তারা কবিতা লিখে, কনসার্ট করে, আড্ডা মারে। তারা মোড়ের টংঘরে বসে চা খায়, তর্কবিতর্ক করে, প্রেম করে। সবকিছুর ওপর তারা দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, দেশকে ভালোবাসে। যে মুক্তিযুদ্ধকে তারা দেখেনি, সেই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তারা গর্ব করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করে আর ভালোবাসে।
কিন্তু সেই ছাত্রটি যদি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সদস্য হয়, তাহলে তাকে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিটিকে নিষ্ঠুরভাবে বুকের ভেতর থেকে মুছে ফেলতে হয়। তারা কেমন করে মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে—আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিটিকে তারা তো কখনোই চায়নি। তাদের দলের নেতারা হচ্ছে নিজামী-মুজাহিদীর মতো মানুষ, যারা একাত্তরে এ দেশের বদর বাহিনীর প্রধান ছিল। বদর বাহিনীর সদস্যরা আক্ষরিক অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছে, যখন টের পেয়েছে সত্যি সত্যি দেশটা স্বাধীন হয়ে যাবে, তখন যেন দেশটি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের একজন একজন করে হত্যা করেছে। যে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে, ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধ করেছে, সেই দলের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে একজন তরুণ কেমন করে একটি সংগঠন করে, আমি কখনোই বুঝতে পারিনি।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি তাদের ছাত্রসংগঠনের সামনে দাঁড়িয়ে কীভাবে তাদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে, আমি সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করেছি, কখনোই বুঝতে পারিনি। তারা কি বলে, ‘আমরা সেই রাজনৈতিক দল যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশাশাপাশি থেকে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, যেন কখনোই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে না পারে। আমাদের মহান নেতা গোলাম আযম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও হাল ছেড়ে দেননি, পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা কমিটি নাম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে আমাদের সব নেতা পালিয়ে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। পঁচাত্তরে শেখ মুজিবকে (তারা নিশ্চয়ই ভুলেও মুখে বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করে না!) হত্যা করার পর যখন জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে দিলেন, তখন আমরা দেশে ফিরে এসেছি! ইত্যাদি ইত্যাদি।’
এ কথাগুলো বলে কি তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করা সম্ভব? তাহলে তারা কী বলে? কেমন করে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি মনে হয় কোনো দিনই জানতে পারব না।
তরুণ প্রজন্মের যারা জামায়াতে ইসলামী বা তাদের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি শুরু করেছে, তারা সম্ভবত আর কখনোই সেখান থেকে বের হয়ে একজন সাধারণ মানুষের মতো দেশকে ভালোবাসতে পারবে না। সারাটা জীবনই তাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা অুনভব করে যেতে হবে। সারা দেশের মানুষ যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘৃণা করে, তাদেরকে নেতা হিসেবে সম্মান করে কাটাতে হবে—কী ভয়ংকর একটা জীবন! যারা সেই জীবন বেছে নিয়েছে, তাদের বলার কিছু নেই। আশা করি, নতুন প্রজন্মের আর কেউ যেন সেই জীবন বেছে না নেয়।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হবে তখন একাত্তরের যে ভয়ংকর ইতিহাস বের হয়ে আসবে, সেটি নিজের কানে শোনার পর তরুণ প্রজন্মের আর কেউ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হওয়ার জন্য এগিয়ে যাবে না। এ দেশে মুসলিম লীগ নামে একসময় অত্যন্ত প্রতাপশালী রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের হুংকারে, বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজেও এ দেশে মুসলিম লীগ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ দেশে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা হবে সেই মুসলিম লীগের মতো!

৩.
মার্চ মাস আমাদের অগ্নিঝরা মাস। এই মাসে বাঙালিরা পাকিস্তানি মিলিটারির ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এই মাস হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলনের মাস, সাত মার্চের মাস, বঙ্গবন্ধুর জন্ম মাস। এই মাস হচ্ছে গণহত্যাকে বুকপেতে নিয়ে স্বাধীনতার মাস। এ রকম চমত্কার একটি মাসে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আল-বদরদের নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। এই মাসে আমাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে।
আমার এখনো নতুন স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। কিসিঞ্জার আমাদের দেশটাকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সে দেশের জিডিপি এখন প্রায় সাত শ ডলার, তিন দিনে এ দেশে এক বিলিয়ন ডলার সৃষ্টি হয়। আমাদের বাজেটের প্রায় পুরোটাই আমাদের নিজেদের, মাত্র ৫ শতাংশ আসে বাইরের দেশ থেকে। একসময় বাইরের দেশের টাকায় দেশের বাজেট হতো বলে এই দেশে দাতাগোষ্ঠী (ইংরেজিতে ডোনার) বলে একটা শব্দ প্রচলিত ছিল। সেই দাতাগোষ্ঠীর সামনে এ দেশের হর্তাকর্তা, বিধাতারা নতজানু হয়ে থাকতেন। দাতাগোষ্ঠীরা কথায় কথায় আমাদের ধমক দিতেন, আমাদের কেমন করে দেশ চালাতে হবে, সেটা নিয়ে নসিহত করতেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও মাঝেমধ্যে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করে দাতাগোষ্ঠীর কাছে নালিশ দিতে যেতেন।
এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের বাংলাদেশের ডিকশনারি থেকে দাতাগোষ্ঠী বা ডোনার শব্দটা আনুষ্ঠানিকভাবে মুছে ফেলা দরকার। এখন এই দেশ বিদেশি কোনো দেশের দানের ওপর নির্ভর করে নেই, তা হলে কেন এখনো তাদের দাতাগোষ্ঠী বলে তোয়াজ করব?
আমি মনে করি, আমরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াব। গোল্ডম্যান স্যাকস নামে একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর সব দেশের সবকিছু বিবেচনা করে ভবিষ্যদ্বাণী করে। তারা বিআরআইসি নামে চারটি দেশের কথা বলেছিল (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীন), যেগুলো বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াবে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে, সত্যি সত্যি এ দেশগুলো পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের পরের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে এন-১১ (নেক্সট ইলেভেন), যেখানে তারা পৃথিবীর এগারোটি দেশের নাম বলেছে, যেগুলো অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এই এন-১১-এর মাঝে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। শুধু যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে তাই নয়, পৃথিবীজুড়ে যে মন্দা গেছে ওই দুঃসময়ে বাংলাদেশের ভূমিকা এত চমকপ্রদ ছিল যে বাংলাদেশ এখন এন-১১ তালিকার ওপর দিকে চলে এসেছে।
বাইরের পৃথিবীর মূল্যায়ন ছাড়াও কি আমরা নিজেরাও সেটা অনুভব করি না? এ দেশের বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম রয়েছে, যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা দেশকে গড়ে তুলতে চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার আর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে, তারা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে দেশ চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে। যদি এই তরুণ প্রজন্মকে একটুখানি পথ দেখিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এ দেশে ম্যাজিক করে ফেলতে পারব।
আমরা খুব আশা করে আছি, যাঁরা দেশকে পথ দেখাবেন, তাঁরা খবরের কাগজও নিয়মিত পড়বেন। তা হলেই তাঁরা জানতে পারবেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় অন্তরায় কিন্তু সিডর, আইলা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা বা জঙ্গি নয়। সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে ছাত্রলীগ। প্রতিদিন খবরের কগজে সারা দেশে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের যে তালিকা ছাপা হয়, সেগুলো পড়লে হতবাক হয়ে যেতে হয়। আমি জানি না, আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন কি না তাঁদের সরকারের সুবিশাল কালজয়ী একটা অর্জন কিন্তু মফস্বল শহরের কোনো একটি পুচকে ছাত্রলীগ নেতা স্কুলে যাওয়া একটা কিশোরীকে উত্ত্যক্ত করে শেষ করে দিতে পারে। কোনো গাণিতিক নিয়মে এই হিসাব মিলবে না কিন্তু এটাই সত্যি।
মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস, আমি কোনো অসুন্দর কথা উচ্চারণ করতে চাইনি, তার পরেও অসুন্দর কথা রূঢ় কথা বলা হয়ে গেল। পাঠকেরা নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।

৪.
সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা বিষয়, না বললেই নয়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কারণে মন্ত্রিপরিষদ ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনার পরিকল্পনাটি বাতিল করে দিয়েছে। দুটি কারণে বিষয়টিতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। প্রথমত, এই সিদ্ধান্তে দেশের সব মানুষ বিশাল এক দুর্ভাবানার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে (তারা দুই হাত তুলে সরকারের জন্য দোয়া করেছে!)। দ্বিতীয়ত, এ বিষয়টিতে সরকার প্রমাণ করেছে যে তারা সাধারণ মানুষের কথা শুনতে রাজি আছে এবং সেই কথা যৌক্তিক মনে হলে তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতেও রাজি আছে!
এটি বিশাল একটি ব্যাপার! সরকারকে এখন বহু দূরের কিছু মনে হয় না, খুব কাছকাছি কিছু মনে হয়।
২৪.৩.১০
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.