মুক্ত খালেদা জিয়ার দিন কাটছে যেভাবে by কিরণ শেখ
২৫ মাসেরও বেশি সময় সাজানো মামলায় কারাবন্দি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কারাগার থেকে বের হলেও মুক্তির স্বাদ পাননি। গুলশানের বাসা থেকে এভারকেয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত ছিল চলাফেরার সীমাবদ্ধতা। অবশেষে সেই শুভক্ষণ দেখা দেয় ৬ই আগস্ট। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের পতনের পর এদিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দণ্ড মওকুফ করে মুক্তির আদেশ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই সংবাদ পান তিনি। মুক্তির পর দিনই ৭ই আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপি’র সমাবেশে ভিডিও বার্তায় বক্তব্য রাখেন বেগম খালেদা জিয়া। এক মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২১শে আগস্ট গুলশানের বাসায় ফিরেন দুর্নীতির দুই মামলার দণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন। মুক্তি পেলেও অসুস্থতার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। যদিও ২৪ ঘণ্টাই চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এরপরও স্বৈরাচার থেকে দেশ, দেশের মানুষ এবং বিএনপি’র নেতাকর্মীরা মুক্ত হওয়ার স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া।
পারিবারিক
সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন এখনো সুস্থ নন। আগে তিনি বন্দি
ছিলেন, এখন মুক্ত। দলের নেতাকর্মীরা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের
নির্যাতন, দমন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ
ফিরে এসেছে। এজন্য বেগম খালেদা জিয়া মানসিকভাবে স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।
সূত্রটি জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার শরীর কিছুটা ভালো থাকলে উনি বই, পত্রিকা
এবং টেলিভিশন দেখে সময় কাটান। পাশাপাশি দলের অনেকেই দেখা করতে চান।
এক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া চাইলে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় সবাইকে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বার্তা দেন তিনি। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যরা প্রায়
প্রতিদিনই বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখতে গুলশানের বাসায় যান।
ওদিকে ৪ঠা
সেপ্টেম্বর রাতে স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশানের
বাসভবনে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ ক্যাথেরিন
কুক। বৃটিশ হাইকমিশনার বাংলাদেশ ও ইউকের সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের
চিন্তা-ভাবনা বেগম খালেদা জিয়াকে অবগত করেন। পাশাপাশি দু’দেশের সম্পর্ক
উন্নয়নে তারা কি করতে চায়, সে বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জানান সারাহ
ক্যাথেরিন কুক। এ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ-ইউকের সম্পর্ক আরও
শক্তিশালী করার জন্য বলেন এবং আগামী দিনে দু’দেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ
প্রত্যেকটা জিনিস যাতে উন্নততর অবস্থায় যেতে পারে, সে বিষয়েও বৃটিশ
হাইকমিশনারকে বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। রাত সাড়ে ৮টায় বৃটিশ হাইকমিশনারের
পতাকাবাহী গাড়ি গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসা ‘ফিরোজা’য় প্রবেশ করেন। প্রায়
ঘণ্টাব্যাপী এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া
দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বৃটিশ হাইকমিশনার এবং তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন।
সাক্ষাতে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা.
এজেডএম জাহিদ হোসেন, মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন
তালুকদার, ডা. এফএম সিদ্দিকী, বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল
উপস্থিত ছিলেন। ২০১৮ সালে কারাবন্দি এবং মুক্তির পর হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে
এই প্রথম বৃটিশ হাইকমিশনার ফিরোজায় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ
করলেন।
মেডিকেল বোর্ডের দু’জন সদস্য মানবজমিনকে বলেন, গুলশানে নিজ
বাসায় বিএনপি চেয়ারপারসন ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার মতো শারীরিকভাবে এখনো তিনি সুস্থ
নন। কারণ মেডিকেল বোর্ড চাচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়াকে যুক্তরাজ্যে কিংবা
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে। বেশ লম্বা সময় ফ্লাই করার মতো শারীরিক অবস্থা হলে
তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে।
খালেদা জিয়ার
ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে নিতে
তার যে দীর্ঘ সময়ের জার্নি সে বিষয়ে তার প্রস্তুতির বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ
করছেন। মেডিকেল বোর্ড বলেছেন, ইউকেতে নেয়া হলে ৮ থেকে ১৩ ঘণ্টা সময় লাগে,
অথবা ইউএসএ নিতে হলে ১৮ থেকে ২১ ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ার লাগবে, কাজেই শারীরিক
সুস্থতার ফর দিস ফ্লাইং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ইউকে ও ইউএসএ’র হসপিটালের
সঙ্গে মেডিকেল বোর্ডের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব বেগম খালেদা
জিয়ার শারীরিক সুস্থতা ফ্লাইংয়ের মতো হলেই বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দেখা
হবে।
বিএনপি’র মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান মানবজমিনকে
বলেন, বিএনপি’র চেয়ারপারসন অসুস্থ। ম্যাডাম গুলশানের বাসভবনে মেডিকেল
বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
৭৯ বছর বয়সী
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস,
কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। সবশেষ গত ৮ই জুলাই গভীর রাতে
বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় খালেদা জিয়াকে। এর
মাসখানেক আগে গত ২রা মে তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার আগে গত
বছরের ৯ই আগস্ট খালেদা জিয়াকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৫
মাসের বেশি সময় চিকিৎসা শেষে গত ১১ই জানুয়ারি তিনি বাসায় ফেরেন। মাঝে
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে তার রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার
করা হয়। এরপর তার স্বাস্থ্য কিছুটা স্থিতিশীল হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি’র চেয়ারপারসন ২০১৮ সালের
৮ই ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। ২০২০ সালের ২৫শে মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার
নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল খালেদা
জিয়াকে। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি
করা হচ্ছিল।
No comments