বিদেশে পোস্টিং বঞ্চিত স্বরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বিভাগ বিধিগত ও সম্মানজনক সমাধান চায়
মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকে সমহারে নিয়োগ-পদায়নের সিদ্ধান্ত থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না। উল্টো মিশনের ৭৩টি পদে সুরক্ষা বিভাগ থেকে এককভাবে পোস্টিং দেয়ার নীতি গ্রহণ করায় ক্ষোভ-অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দূতাবাসগুলোয় এই প্রাইজ পোস্টিংয়ের ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে এখন জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চলছে এক ধরনের নীরব রেষারেষি। এর আগে ২০২০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগকে বাদ দিয়ে শুধু সুরক্ষা বিভাগ থেকে ৪ জনকে বিদেশ মিশনে পোস্টিং দেয়ায় তখন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একই বছর ১৮ই আগস্ট তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দুই বিভাগে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের একটি চিঠি দেয়া হয়। যেটার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে ২০১৭ সালে মিশনে পদায়ন নিয়ে ক্ষোভের সঞ্চার হলে উভয় বিভাগকে সমন্বিত রাখার জন্য জননিরাপত্তা ও সুরক্ষাসেবা বিভাগের কর্মচারীদের সমহারে বিভিন্ন দূতাবাসে পদায়নের জন্য একই বছর ১লা মার্চ একটি পরিপত্র জারি করে। পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মচারীদের পক্ষ থেকে জারিকৃত পরিপত্রটিকে সঠিক নয় এবং তাদের সরকারবিরোধী বলে প্রচার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জারিকৃত পরিপত্রটি দীর্ঘ দুই বছর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলে বাস্তবায়িত না হওয়ায় জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মচারীরা ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। যার নম্বর-৯৮৬৩/২০১৯। রিট অনুযায়ী বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে উভয় বিভাগ থেকে সমহারে জনবল পদায়নের জন্য ২০২৩ সালের ৬ই এপ্রিল একটি রায় প্রদান করেন। পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগ উচ্চ আদালতের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজ কোর্টে একটি আবেদন করলে কোর্ট রায়টি স্থগিত না করে ৮ সপ্তাহের জন্য স্ট্যাটাসকো প্রদান করেন। এ সময় সুরক্ষাসেবা বিভাগ বিদেশে জনবল পদায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মচারীরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বরাবর বিদেশে জনবল পদায়ন কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য ২০২০ সালের ১৮ই আগস্ট এবং গত ১০ই মার্চ ২টি আবেদন করেন। যেখানে আদালত এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশ অবমাননা করে বিভিন্ন মিশনে সুরক্ষাসেবা বিভাগ জনবল পদায়ন করে। এ বিষয়ে অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র। জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে চরম এই বৈষম্যের বিষয়টির নিরসন চেয়ে ২০১৭ সালে জারিকৃত পরিপত্র এবং এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার একান্ত হস্তক্ষেপ কামনা করেন। উল্লেখ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস-হাইকমিশনের অফিসসমূহের কনস্যুলার সার্ভিস শাখায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও ৬টি মন্ত্রণালয়-বিভাগ সেবা দিয়ে থাকে। অন্য মন্ত্রণালয়গুলো হলো- পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, ইআরডি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ৪টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র ইআরডি থেকে মিশনে যেতে পারেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ মিশনের নির্ধারিত ডেস্কে ২০১৪ সাল থেকে পোস্টিং পেয়ে আসছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমানে ১৯টি মিশনে তিন ক্যাটাগরিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৭৩টি পদ রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ১৯টি। যেখানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রথম ও দ্বিতীয়, সচিব হিসেবে প্রথম শ্রেণির পদে পদায়ন করা হয়। এ ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির ১০টি এবং তৃতীয় শ্রেণির রয়েছে ৪৪টি পদ। স্বামী-স্ত্রী ও ২ সন্তানসহ ৪ বছর মেয়াদি এই প্রাইজ পোস্টিং পেতে অনেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। মিশন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো হলো- সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতারের দোহা, কুয়েত, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, ইতালি, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও বার্মিংহাম, কানাডার অটোয়া, হংকং এবং দক্ষিণ আফ্রিকার গিটুরিয়া। আইন ও বিধিগত সবদিক পর্যালোচনা করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত নথির একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন ২০১৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। যার মূল বিষয় ছিল- বিদেশ মিশনে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগ থেকে সমহারে নিয়োগ দিতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষরে ওই বছর ১লা মার্চ একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়- বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা বিভাগ থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমহারে নিয়োগ-পদায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এ জন্য উভয় বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোয় সমহারে পদায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে দুই বিভাগের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত নির্বাচন কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কমিটি এ সংক্রান্ত ২০১৪ সালের নীতিমালার ২.১, ৫.১, ৬.৮, ৭.১ এবং ১০.১ অনুচ্ছেদসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। কিন্তু মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত এবং এই পরিপত্র জারির দীর্ঘ ৮ বছর পার হলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
এ বিষয়ে জননিরাপত্তা বিভাগের একাধিক সচিবের সঙ্গে কথা বললে তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের এক সদস্য বলেন, এক মন্ত্রণালয়ের দুটি দপ্তর যেমন থাকতে পারে না। একইভাবে দপ্তর আলাদা হলেও মন্ত্রণালয় তো একই। অতএব আমাদের একটিই চাওয়া ২০১৭ সালে জারিকৃত পরিপত্রের বাস্তবায়ন। এবং এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার একান্ত হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
No comments