জীবনের প্রতি হুমকি থাকায় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করিনি -ভারতীয় পত্রিকাকে খালেদা জিয়া

জীবনের প্রতি হুমকি থাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাননি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ভারতের দ্য সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেছেন।
খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎটি আমি বাতিল করেছিলাম। কারণ, আমার জীবনের প্রতি হুমকি ছিল। আমার যদি কিছু হয়ে যেত (সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পথে), তাহলে সে জন্য জামায়াতকে দোষী করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের প্রতিপক্ষের।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ৭ জুন সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়া। এর কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারটি নেন সানডে গার্ডিয়ান-এর সাংবাদিক সৌরভ সান্যাল। গত শনিবার সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং খালেদা জিয়ার জবাব সংক্ষিপ্ত আকারে:
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার বৈঠক কেমন হলো?
খালেদা জিয়া: এটা খুবই সন্তোষজনক সাক্ষাৎ। আমি অবশ্যই বলব, সাক্ষাৎটি হয়েছে খুবই আন্তরিক পরিবেশে। আমি খুবই সন্তুষ্ট।
প্রশ্ন: আপনাদের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কী ছিল?
খালেদা জিয়া: আমি আগেই বলেছি, সাক্ষাৎটি ছিল খুবই আন্তরিক। আপনি জানেন, এটা একান্ত সাক্ষাৎ। কাজেই আমরা কী নিয়ে কথা বলেছি, তা আমি বলতে পারি না। তবে এটি অবশ্যই সন্তোষজনক সাক্ষাৎ।
প্রশ্ন: সাক্ষাৎটি হবে কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবার মধ্যে একটা সংশয় ছিল। আপনি ঠিক কখন নিশ্চিত হলেন যে সাক্ষাৎটি হচ্ছে? এ নিয়ে সংশয়ই বা কেন তৈরি হলো?
খালেদা জিয়া: সংশয়ের কি আদৌ কিছু ছিল? আমি কি একবারও বলেছিলাম যে আমি মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব না? নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আমার দলের কোনো একজন নেতাকেও কি বলতে শুনেছেন যে আমি মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব না? মোদি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশটির নেতা। তিনি এখানে এসেছেন দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে। সাক্ষাৎ নিয়ে সংশয় যেটা তৈরি হয়েছিল, তা খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা একটি ভুল বার্তা দিতে চেয়েছিল এবং সর্বোচ্চ চেষ্টাই তারা করেছে। মোদির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎটি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেনি।
প্রশ্ন: ম্যাডাম, তাহলে কি আপনি এই অভিযোগ করছেন যে বাংলাদেশ সফরের সময় মোদির থেকে আপনাকে দূরে রাখতে সব দিক থেকে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছে? এর পেছনে কারা আছে?
খালেদা জিয়া: ঘটনাটি আমি সরাসরি বলি শুনুন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছেন, মোদির বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তাঁর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু নয়াদিল্লি তখন সবকিছু পরিষ্কার করল। মোদির সফরের আগের দিন সন্ধ্যায় এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই কথা জানানোর কয়েক ঘণ্টা পরই নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর জানিয়ে দেন, সাক্ষাৎটি হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। আপনি এটাকে কীভাবে দেখবেন? ভারতের কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ জানাই। সাক্ষাৎটি যাতে না হয়, সে জন্য যা যা করা যায় বাংলাদেশের সরকার তা করেছে। মোদির সঙ্গে আমি কোনো কথা বলি তারা সেটা চায়নি।
প্রশ্ন: এখন সরাসরি আপনাকে একটি প্রশ্ন করি। আপনি যেমনটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঠেকানোর জন্য সরকার একটি সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে দেখি, ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন ঢাকায় এলেন, তখন আপনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না...
খালেদা জিয়া: আপনি যে এ প্রশ্নটি আমাকে করলেন, এ জন্য আমি খুশি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধে তিন শীর্ষ নেতাকে সাজা দেওয়ায় জামায়াতে ইসলামী তখন ধর্মঘট ডেকেছিল। তখন আমি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎটি বাতিল করেছিলাম এ জন্য যে আমাদের কাছে তথ্য ছিল, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে আমার ওপর হামলা হবে। সেটা আমার জীবনের জন্য হুমকিও হতে পারে। আপনার মনে থাকতে পারে, তিনি যে হোটেলে ছিলেন এবং যে পথ দিয়ে আমার সেখানে যাওয়ার কথা ছিল, তার পাশেই পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রশ্ন: কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তো আপনাদের জোটের শরিক। তারা কেন আপনার ওপর হামলা করতে চাইবে?
খালেদা জিয়া: একেবারে ঠিক, এটাই মূল কথা। আমার যদি কিছু হতো, পুরো ঘটনার দায় জামায়াতের ওপর চাপানোর চেষ্টা হতো। এবং এটাই ছিল আমাদের প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা। এটা আমরা বুঝে ফেলেছিলাম এবং এরপর আমরা সাক্ষাৎটি বাতিল করি। সত্য ঘটনা আজ আমি আপনাকে জানালাম।
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আপনি কেন সাক্ষাৎ করেননি, সে সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানালেন। কিন্তু এর বাইরেও ভারতবিরোধী হিসেবে আপনার একটি পরিচিতি আছে...
খালেদা জিয়া: আমি কেন ভারতবিরোধী হতে যাব? দেখুন, আমি আপনাকে যা বলছি শুনুন। আমাকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে তুলে ধরার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার জোর প্রপাগান্ডা চালায়। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধন অনেক জোরালো এবং আমাদের স্বাধীনতার পেছনে তাদের অবদানকে আমরা পুরোপুরি স্বীকৃতি দিই। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর। এমন সময় তারা আমাকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে। আমাকে এবং বিএনপিকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে একটি সুপরিকল্পিত প্রপাগান্ডা যন্ত্র অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তো আপনাদের জোটের শরিক। তাদের ধর্মীয় কট্টরপন্থী হিসেবেই দেখা হয় এবং আচরণেও তারা ভারতের প্রতি ইতিবাচক নয়...
খালেদা জিয়া: জামায়াত আমাদের জোটের শরিক এবং শুধু এটাই। জোটে তাদের বিএনপির কথা শুনতে হয়। দেখুন, আমরা যেহেতু এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছি, আমাকে বলতে দিন, আপনি শুনে বিস্মিত হবেন যে কীভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে হিন্দুরা আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত হয়। তাদের ঘরবাড়ি লুট করা হয়, জমি দখল করা হয়…আর আমাদের বলা হয় হিন্দুবিরোধী? আমরা হিন্দুদের সঙ্গে আছি এবং দেশের সব নাগরিকের কল্যাণ চাই।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে, আমাদের নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে, প্রায় ২০ হাজার নেতা গুম হয়েছেন এবং কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাঁকে চিহ্নিত করে তার ওপর হামলা হচ্ছে। এখানকার পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার চেয়েও খারাপ। আমি কথা বললেই আমাকে বলা হয় পাকিস্তানি এজেন্ট। আমার স্বামী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। যখন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তখন তিনি একজন মেজর ছিলেন, এটা কি আমরা ভুলে যেতে পারি?
প্রশ্ন: কিন্তু বেগম জিয়া, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি কার্যত আওয়ামী লীগকে ‘ওয়াকওভার’ দিয়েছেন। এবং আজ আপনি বলছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
খালেদা জিয়া: ...আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। ভোট জালিয়াতির জন্য তারা পুরো সরকারব্যবস্থা এবং পুলিশকে ব্যবহার করবে। দেখেন, সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী হলো। ভোটাররা যখন ভোটকেন্দ্রে গেল তখন তাদের বলা হলো বাড়ি ফিরে যেতে, তাদের ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের সময় একজন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের রেকর্ডই প্রমাণ করে দেবে ভোটে পুলিশ কীভাবে প্রভাব খাটিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারি?
এখন যে ঘরে বসে আমরা কথা বলছি, এখানে আমাকে ৯২ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা যোগাযোগের লাইনগুলোও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হলো, খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিল, এমনকি একসময় পানি আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। এটাই আসল ঘটনা।
প্রশ্ন: তাহলে সামনে এগোনোর পথ কী, বেগম জিয়া?
খালেদা জিয়া: আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং জনগণের মত নেওয়ার এটাই একমাত্র পথ। বাংলাদেশ এখন কী অবস্থায় আছে, সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই দেখা দরকার।

1 comment:

Powered by Blogger.