যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি শুধু ধনবানদের জন্য নয় -নিউইয়র্কে নির্বাচনী প্রচারণায় হিলারি by হাসান ফেরদৌস

ম্যানহাটন ও কুইন্সের মাঝখানে ক্ষুদ্র একখণ্ড দ্বীপ রুজভেল্ট আইল্যান্ড। দড়িপথে ম্যানহাটনে পৌঁছাতে বড়জোর ১০ মিনিট। ইস্ট রিভারের পাড়ে এই দ্বীপটির ওপর চার একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ফোর ফ্রিডমস পার্ক’, যা যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের স্মৃতির প্রতি নিবেদিত। শনিবার এখানেই তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম উল্লেখযোগ্য ভাষণটি দিলেন হিলারি ক্লিনটন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে প্রার্থিতা ঘোষণার পর প্রায় দুই মাস হয়ে গেলেও এর আগ পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটন কোনো বড় ধরনের নির্বাচনী সভা করেননি। বিভিন্ন শহরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান করেছেন মার্কিন নাগরিকদের কথা শুনতে। বাকি সময় কাটিয়েছেন নির্বাচনী তহবিলের জন্য চাঁদা সংগ্রহে।
শনিবারের বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচনী সভায় হিলারি অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন তিনি কেন প্রেসিডেন্ট হতে চান, সে কথার ব্যাখ্যায়। হিলারি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর এই লড়াই। যারা ওপরে উঠতে চেয়ে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, অথচ নুয়ে পড়েনি, তিনি তাদের জন্য লড়বেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুধু করপোরেশনগুলোর প্রধান নির্বাহীদের ও হেজ ফান্ড ম্যানেজারদের জন্য হতে পারে না। গণতন্ত্র শুধু বিলিয়নিয়ার ও করপোরেশনগুলোর জন্য হতে পারে না। সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রে সবার সমান অধিকার রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে আপনারাই এ দেশকে ফিরিয়ে এনেছেন। এখন আপনাদের সময় এসেছে সেই সমৃদ্ধির ভাগ নেওয়ার এবং সামনে এগিয়ে চলার।’
হিলারি তাঁর ভাষণের একটি বড় অংশ ব্যয় করেন নিজের মায়ের পরিচয় তুলে ধরতে। অতিদারিদ্র্যের ভেতরে তাঁর শৈশব কেটেছে, অন্যের মহানুভবতায় তিনি লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন এবং অবশেষে জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। ‘মা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন আমাদের কেন লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত, এমনকি যখন পথ বন্ধুর ও প্রতিপক্ষ প্রবল।’
হিলারির ভাষণের সময় তাঁর স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তাঁদের একমাত্র কন্যা চেলসি ক্লিনটন উপস্থিত ছিলেন, তবে তাঁরা কোনো বক্তব্য দেননি।
নিউইয়র্কের এই নির্বাচনী সভার মাধ্যমে হিলারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তাঁর প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনব্যবস্থায় দলের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে এক দীর্ঘ ‘প্রাইমারি’ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি রাজ্যে প্রধান দুই দল ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টি তাদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নির্বাচন করতে ‘প্রাথমিক ভোট’-এর ব্যবস্থা করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলের সবচেয়ে অনুগত সদস্যরাই এই প্রাথমিক ভোটে অংশ নিয়ে থাকেন। সে কথা মাথায় রেখে প্রত্যেক প্রার্থী এই প্রাক্-নির্বাচনী পর্বে দলের কট্টর সমর্থকেরা খুশি হন, এমন বক্তব্যই দিয়ে থাকেন।
হিলারিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশ ইতিমধ্যে তাঁকে ওয়ালস্ট্রিট তথা ধনিক গোষ্ঠীর নিকট মিত্র হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’ ওয়ালস্ট্রিট ও বিভিন্ন বিদেশি দাতার কাছ থেকে মোটা চাঁদা নিয়েছে, এমন অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে। নিউইয়র্কের বাম-ঘেঁষা মেয়র বিল ডি ব্লাজিও সরাসরি বলেছেন, অর্থনৈতিক সমতা প্রশ্নে সুস্পষ্ট কর্মসূচি না দেওয়া পর্যন্ত তিনি হিলারিকে সমর্থন জানাবেন না। ইতিমধ্যে আরও দুজন রাজনীতিক ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থিপদ ঘোষণা করেছেন। তাঁরা হলেন ভারমন্ট থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও ম্যারিল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্টিন ও’ম্যালে। তাঁরা উভয়েই ক্লিনটনের তুলনায় অধিকাংশ প্রশ্নে বেশি বামপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
এসব কথা মাথায় রেখেই হিলারি তাঁর ভাষণে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যদের কাছে জনপ্রিয় হবে এমন বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, সমতা অর্জনের লক্ষ্যে সবার জন্য প্রাক্-স্কুলব্যবস্থা সমর্থন করবেন। কলেজ শিক্ষা যাতে নিম্নবিত্তদের সাধ্যের ভেতরে থাকে, সে উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ নেবেন এবং অবকাঠামো খাতে অধিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করবেন। হিলারি প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানান এবং অভিবাসন প্রশ্নে রিপাবলিকান দলের কট্টর অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেন। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নেও তিনি নিজের স্পষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করেন।
তিনি প্রার্থী হিসেবে বয়স্ক—রিপাবলিকান দলের এই সমালোচনার জবাবে হিলারি বলেন, ‘এ কথা ঠিক, চলতি প্রচারণায় আমি সবচেয়ে নবীন প্রার্থী নই। কিন্তু নির্বাচিত হলে আমি হব যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম নারী প্রেসিডেন্ট।’
শনিবার দুপুরে নিউইয়র্কের অনুষ্ঠান শেষেই আইওয়া অঙ্গরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন হিলারি ক্লিনটন। ২০০৮ সালে প্রার্থিতার দৌড়ে এই আইওয়াতেই তিনি বারাক ওবামার কাছে প্রায় ৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.