হালাল খাবার নিয়ে কানাডায় জাতীয় দিবস উদযাপন by মঈনুল আলম

পাশ্চাত্যে বর্তমানে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ভাব দেখা গেলেও কানাডার বৃহত্তম নগরী টরন্টোতে ইসলামি অনুশাসন ও মুসলমানদের আচারবিধির ব্যাপারে নব উপলব্ধি এবং সম্মানের মনোভাব গড়ে উঠছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কানাডার বৃহত্তম দৈনিক সংবাদপত্র টরন্টো স্টারে মুসলমানদের আচারবিধি সম্পর্কে পরপর একাধিক সচিত্র প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে।  ১৫ অক্টোবর দৈনিক নয়া দিগন্তে আমার লিখিত ‘কানাডায় হিজাবের নব সমাদর’ প্রকাশিত হয়। এর তিন দিন আগে কানাডার জাতীয় ‘থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’ (জাতীয় ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস) উদযাপন দিবসে টরন্টোর ‘মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার’ সব ধর্মের এবং সামাজিক স্তরের কানাডাবাসীর মধ্যে বিনামূল্যে শুধু হালাল খাদ্য পরিবেশন করে দিনটি পালন করল। তা টরন্টোর মিডিয়ার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে।  কানাডার বৃহত্তম দৈনিক সংবাদপত্র ‘টরন্টো স্টার’ হান্ড্রেডস ইন রিজেন্ট পার্ক গেট এ টেস্ট অফ হালাল থ্যাঙ্কসগিভিং’ (রিজেন্ট পার্কে শত শত মানুষ হালাল থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের স্বাদ গ্রহণ করল)Ñ তিন কলাম বিস্তৃত এই হেডলাইন দিয়ে সচিত্র শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘টরন্টো মহানগরী’ সেকশনের প্রথম পৃষ্ঠায়। শিরোনামে ‘হালাল থ্যাংকসগিভিং’ বাগধারা ব্যবহারটিও লণীয়।
প্রতিবেদন শুরু করা হয় এই ভাষায় : ‘এই উইকঅ্যান্ডে সারা দেশে কানাডীয়রা যখন থ্যাঙ্কসগিভিং পালনের জন্য সমবেত হচ্ছে, তখন রিজেন্ট পার্কে একটি নতুন ধরনের সমাবেশ হচ্ছে। রোববার অপরাহ্ণে ক্রিশ্চিয়ান রিসোর্স সেন্টারে শত শত মানুষ সমবেত হয়েছে থ্যাঙ্কসগিভিং উপলে এই প্রথম বিনামূল্যে হালাল খাবারে মধ্যাহ্নভোজ করার জন্য। দুই দশকের বেশি আগে প্রতিষ্ঠিত, মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার নামীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান এই হালাল খাবার পরিবেশনের আয়োজন করেছে।’
এতে উল্লেখ করা হয়, মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিনামূল্যে হালাল খাবারে মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশনের আয়োজন করা হয়েছে খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠান ক্রিশ্চিয়ান রিসোর্স সেন্টারে। এতে কানাডায় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সম্মানের একটি পরিমাপ পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উজ্জ্বল রঙের টেবিল কথ দিয়ে ঢাকা সারি সারি টেবিলে সব ধর্মের ও সব সামাজি স্তরের ... মুসলিম, খ্রিষ্টান, রিজেন্ট পার্কের অধিবাসী, গৃহহীন মানুষ এবং অন্যরা বসে হালাল মুরগির গোশত, ভাত, রুটি এবং সালাদ চর্বণ ও আস্বাদন করছে। খাদ্য পরিবেশনকারী স্বেচ্ছাসেবকেরা খাদ্য পরিবেশনের পাশাপাশি ভোজনকারীদের সাথে কৌতুকালাপ করছে, তাদের কাপে স্যুপ ইত্যাদি ঢেলে দিচ্ছে এবং সব কিছু মিলে বিনামূল্যে হালাল খাদ্য পরিবেশন অনুষ্ঠানটি চারতারা মানের রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশনের চেয়েও আনন্দময় হয়ে উঠেছে।’
উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য (মেজর) মোহাম্মদ আব্বাস আলি ও তার স্ত্রী সরোয়ার জাহান বেগম ১৯৯৩ সালে টরন্টোতে একটি ছোট্ট ‘হালাল ফুড ব্যাংক’ স্থাপন করেন। সেটাই পরে মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারে পরিণত হয়ে দুই দশকের বেশি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দুস্থ এবং গৃহহীনদের হালাল খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার এখন বৃহত্তর টরন্টো এলাকার অন্তর্গত দু’টি শহর হুইটবি ও মিসিসাগাতে দু’টি হালাল ফুড ব্যাঙ্ক খুলেছে, যেখান থেকে নয় হাজারের অধিক দুস্থ পরিবার হালাল খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া হুইটবি শহরে এই সোসাইটি দুস্থদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করছে, যেখানে ৪৫ জন পর্যন্ত নিরাশ্রয় নারী ও শিশু আশ্রয় নিতে পারে। হুইটবিতে একটি ইমার্জেন্সি মোটেল রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো দুর্গত পরিবার জরুরিভাবে কয়েক দিনের জন্য আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া নবাগত ইমিগ্র্র্যান্ট, রিফিউজি ও ভিজিটরদের যাদের হেলথ কভারেজ থাকে না, তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি দাতব্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে স্থানীয় চিকিৎসকেরা বিনা ফিতে রোগীদের চিকিৎসা করে থাকেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মেজর আব্বাসের সন্তান আলি, যিনি এখন মুসলিম ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কর্ণধার, টরন্টো স্টারকে বলেন, ‘আমার বাবা দরিদ্র ছিলেন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার; তার কোনো সহায়-সম্পত্তি ছিল না; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, যেকোনো ব্যক্তি সমাজের দুস্থ ও অসহায়দের সাহায্য করতে পারে, যদি সে ব্যক্তির ইচ্ছা ও দৃঢ় সঙ্কল্প থাকে। শুরু থেকেই মেজর আব্বাস যে মন্ত্রটি গ্রহণ করে এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পদপে নেন, তা হলো ‘মানবতার সেবা করা হলো আল্লাহর সেবা করা’। আলি বলেন, সে মন্ত্রই এই প্রতিষ্ঠানের মূল মন্ত্র হয়ে আছে। এর কোনো পরিবর্তন হবে না।
লেখক : প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক
moyeenulalam@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.