সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয় by কাফি কামাল ও দীপক আহমেদ

আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আসুন সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। সময়মতো আন্দোলনের ডাক দেবো। এ সরকারকে বিদায় করে আমরা ঘরে ফিরবো। যারা দেশের পক্ষে থেকে, মানুষের পক্ষে থেকে আন্দোলন করে তারা পরাজিত হতে পারে না। অনেক মার খেয়েছি, এবার রক্ত দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। জয় আমাদের হবেই। আন্দোলনের সময় নির্ঘণ্ট না জানিয়ে তিনি বলেন, কবে আন্দোলন শুরু করবো তা আমি সময়মতো জানাবো। আগে মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে নিই। তারপর সবাই মিলে আন্দোলনের ডাক দেবো। সবাই মিলে আন্দোলন করবো। এরশাদকে বিদায় করেছি, হাসিনাকে বিদায় করে গণতন্ত্র আনবো। বাকশাল নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো। গতকাল নীলফামারী শহরের বড় মাঠে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত লাখো মানুষের সমাবেশে তিনি এ সব কথা বলেন। ৫৫ মিনিটের বক্তব্যে খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কড়া সমালোচনা করে প্রতিষ্ঠান দু’টি পুনর্গঠনের দাবি জানান। নতুন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম না বাড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সাম্প্রতিক প্রতিটি সমাবেশের ধারাবাহিকতায় সরকারের সমালোচনা ও র‌্যাব বাতিলের দাবি জানান বিরোধী জোট নেতা। আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। দাবি না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমে এই অবৈধ সরকারকে বিদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়া গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে নীলফামারীতে নিহত চার বিএনপির নেতা আতিকুল ইসলাম, আবুবকর সিদ্দিক, মহিবুল হক ও গোলাম রব্বানির পরিবারকে সার্কিট হাউজে ডেকে সমবেদনা জানান খালেদা জিয়া। এসময় তিনি প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে নগদ আর্থিক সহায়তা দেন। নীলফামারী যাওয়ার পথে রংপুরের বড় দরগা এবং ঢাকায় ফেরার পথে রংপুরের পাগলা মাজার ও মহাস্থানগড় মাহি সওয়ার মাজার জিয়ারত করেন খালেদা জিয়া।
সরকারকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি
বিরোধী জোট নেতা বলেন, পৃথিবীর কোন দেশ এ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের সঙ্গে ছবি ওঠালেই স্বীকৃতি হয় না। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে বিদেশীরা কোনদিন স্বীকৃতি দেবে না। বিদেশীরা দেখেছে, এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তাই তারা স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার বলছে- আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। আমরা বলতে চাই, গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন হয় না। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র। সরকারের কথার অর্থ হচ্ছে- আগে কমিশন তারপর উন্নয়ন। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন সরকার দেশে নেই। এ সরকার অবৈধ। আপনারা এদেরকে ভোট দেননি। এরা নির্বাচিত নয়। তাই অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বলেছি।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে
খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, যে নির্বাচন কমিশন আছে তারা অথর্ব। এ অথর্ব নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই এ কমিশনকে বাতিল করে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেন- সেই ডিসি, এসপি, ওসি নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। খালেদা জিয়া তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের কি ভোট দিতে ইচ্ছে করে না?  কিন্তু এ অবৈধ সরকার তোমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। অধিকার কেড়ে নিলে আন্দোলন করতে হয়। তাই কঠোর আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকামুখী ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি দিয়েছিলাম। সরকার এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, তারা পুলিশ দিয়ে আমার বাড়ি ঘেরাও করে ক্ষান্ত হয়নি। বাড়ির সামনে বালির ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল।
দুদক এখন দুর্নীতি করার প্রতিষ্ঠান
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী খেয়ে দেয়ে বেশ মোটা তাজা হয়েছিলেন। পরে দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল। কিন্তু দুদক তাকে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দিয়েছে। এখন মন্ত্রীরা বিয়ে করতেও শুরু করেছেন। তিনি বলেন, সরকারের দুর্নীতিবাজদের তদন্তের নামে দুদক বলছে- তাদের কোন দুর্নীতি পাওয়া যায় না। আসলে দুদক এখন দুর্নীতির করার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকার যেভাবে বলছে সেভাবেই তারা কাজ করছে।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াবেন না
খালেদা জিয়া বলেন, অবৈধ সরকারকে বলতে চাই, আমরা শুনতে পাচ্ছি- আপনারা বিদ্যুৎের দাম বাড়াবেন, গ্যাসের দাম বাড়াবেন। এটা দেশের মানুষ মেনে নেবে না। তিনি সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, কি এগুলোর দাম বাড়ানো উচিত হবে? তারা ‘না না’ জবাব দেন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ালে মানুষের কষ্ট হবে। কিন্তু সরকারের লোকজনের গায়ে লাগবে না। কারণ তাদের পকেট ভর্তি দুর্নীতির টাকা। তাই আপনাদের প্রতিবাদ করতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, সরকার বিদ্যুৎ দেয়ার কথা বলে, কুইক রেন্টাল করেছে। ঢাকায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না আপনারা কি বিদ্যুৎ পান? সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও জামালপুর গেলাম তারা বলেছে, তারা বিদ্যুৎ পায় না। তাহলে বিদ্যুৎ কোথায় যায়, কত উৎপাদন হয়। বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার মিথ্যা কথা বলছে। কুইক রেন্টালের নামে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। অথচ দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পায় না।
বিচারপতিদের বেঞ্চ দিচ্ছে না সরকার
বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া বলেন, এ অবৈধ সরকার ক্ষমতায় বসে নতুন নতুন আইন করছে। সম্প্রচার আইন করছে, অভিশংসন আইন করছে। বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করতে সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে। এরই মধ্যে অনেককে নিষিদ্ধ করেছে যাদের টকশোতে নেয়া যাবে না। এর আগেও তারা একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। চারটি বাদে সবগুলো কাগজ বন্ধ করে দিয়েছিল। এবারও করছে। তাই এদের উপর ভরসা করা যায় না। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করেছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, বিচারপতিদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা। তাই বিচারপতিতে অপসারণে সংসদে আইন করছে। তারা যাকে যতদিন সাজা দিতে বলবে বিচারপতিদের তা মানতে হবে। নইলে তাদের চাকরি থাকবে না। দেশবাসীকে এখন ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বিচারকদের বেঞ্চ পর্যন্ত দেয়া হয় না। বেছে বেছে এমন বিচারকদের বেঞ্চ দেয়া হয় যারা আমাদের বিরুদ্ধে সরকারের কথা মতো সাজা দেবে।
র‌্যাব বাতিল করতে হবে
র‌্যাব গঠনের প্রেক্ষাপট এবং তাদের বর্তমান অবস্থান প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, র‌্যাব গঠন কেন করতে হয়েছিল? ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছিল। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে আমাদের র‌্যাব গঠন করতে হয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য, মানুষ খুন-গুম করার জন্য র‌্যাব গঠন করা হয়নি। কিন্তু এখন তাদের সে কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তারা এখন মানুষ খুন করছে টাকার বিনিময়ে। আপনারা নারায়ণগঞ্জে দেখেছেন না? তাই আমরা বলেছি, র‌্যাব বাতিল করতে হবে। র‌্যাব দিয়ে গুম-খুন চলতে দেয়া যায় না, চলতে দেবো না। বিদেশীরাও তাই বলছে র‌্যাব বাতিল করতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। আপনাদের বলতে চাই, সরকারের অবৈধ আদেশ শুনবেন না। গুম-খুন বন্ধ করেন। পুলিশ জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করাই আপনাদের দায়িত্ব। মনে রাখবেন, আপনাদেরও মা-বোন-ভাই আছে। তাদেরও জীবন আছে। তাদের কথা ভুলে যাবেন না।
এ সরকার মামলাবাজ
খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। কিন্তু এ সরকার দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করছে। এ সরকার জানে কেবল কথায় কথায় মামলা দায়ের। আপনারা হাসিনাকে প্রশ্ন করেন, তার বিরুদ্ধে এখন কয়টি মামলা আছে? অথচ এক সময় তার বিরুদ্ধেও ১৫টি মামলা ছিল। তারা ক্ষমতায় এসেছে তার ও তার দলের নেতাদের মামলা তুলে নিয়েছে। কিন্তু কেন সে মামলা প্রত্যাহার করা হল? আমার নামে চারটি মামলা ছিল তা প্রত্যাহার করা হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, হিন্দুদের বাড়িঘর কারা দখল করেছে? হিন্দুদের প্রতিমা কারা ভেঙেছে? হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে বাড়িঘর, জমি-জমা কারা দখল করেছে? এ আওয়ামী লীগ। আপনাদের মনে আছে, বিশ্বজিৎ দাশকে কারা মেরেছে? ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মেরেছে। আপনাদের মনে আছে, চন্দন সরকারকে কারা মেরেছে? র‌্যাবকে দিয়ে এ সরকার মেরেছে। যে মেরেছে তাকে এখন জামাই আদরে রাখা হয়েছে। কিন্তু আজ না হোক, একদিন বিচার হবে।
বিনিয়োগ নেই, জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ
খালেদা জিয়া বলেন, দেশে এখন বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশে যারা বিনিয়োগ করছে তারাও বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ সরকার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ দিতে পারে না। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিতে বিনিয়োগকারীরা অতিষ্ঠ। দেশে বিনিয়োগ না থাকায় উন্নয়ন থমকে গেছে। দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। তিনি বলেন, রিহ্যাব ফ্ল্যাট তৈরি করে বসে আছে বিক্রি করতে পারছে না।
জনসমুদ্র নীলফামারী শহর
দীর্ঘ ১৪ বছর পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভাকে কেন্দ্র করে উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছিল নীলফামারী। রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ সন্নিহিত জেলাগুলো থেকে বাস-ট্রাক-নসিমন-করিমন-ভ্যান ভরে সকাল থেকেই ২০দলের কর্মী সমর্থকদের স্রোত এসে মিশে সীমান্তবর্তী এ শহরে। দুপুরের মধ্যেই জনসভার মাঠ ছাপিয়ে প্রায় পুরো শহর পরিণত হয় জনারণ্যে। সমাবেশকে ঘিরে পুরো শহরে ছিল উৎসবের আমেজ। এদিকে বগুড়া থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় রওনা দিয়ে বিকাল সাড়ে ৩টায় নীলফামারী পৌছান। সার্কিট হাউজে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সমাবেশস্থলে যান। খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে পথের ধারে স্থানে স্থানে আয়োজন করা হয় পথসভার। কিন্তু চলতি পথে হাত নেড়ে অভিনন্দনের জবাব দিয়েই সোজা নীলফামারী পৌছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
নীলফামারী জেলা বিএনপির আহবায়ক এ্যাডভোকেট আনিছুল আরেফিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় ২০দলীয় জোটের শরিক দল এলডিপি সভাপতি কর্ণেল (অব) অলি আহমেদ বীরবিক্রম, জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যাপক মজিবর রহমান, বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, খেলাফত মজলিশের আমীর মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের আমীর মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, সমাবেশের সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতিক, ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি, খন্দকার গোলাম মর্তুজা, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সামসুজ্জামান জামানসহ ২০দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন। জনসভা শেষে রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

No comments

Powered by Blogger.