মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কান্না by দীন ইসলাম

দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে ৩০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকের কান্না চলছে। রাতে ইমিগ্রেশন পুলিশ, দিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকের যন্ত্রণায় কাটছে তাদের দিন। মালিকের সঙ্গে বেশি বাড়াবাড়ি করলে রক্ষা নেই। জেলখানায় বন্দি হতে হয়। ভিসার মেয়াদ না থাকায় নারী-পুরুষ কর্মীরা বাধ্য হয়ে কম বেতনেই বিভিন্ন স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন। এভাবে যারা কষ্ট মেনে নিয়ে কাজ করছেন, তারা বাসস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। মুসলিম প্রধান দেশটিতে নারী শ্রমিকেরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশের রেড এলার্ট। গত বছরের ২৩শে ডিসেম্বরের পর পুলিশি আতঙ্কে কাটছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের দিনকাল। ওই দিন মালদ্বীপ সরকার এক ঘোষণায় বলেছে, অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় নিজ খরচে দেশে ফেরত যেতে চায় তাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে কোন আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সহজেই তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে পারবেন। এমন ঘোষণা যারা আমলে নেননি তাদের বিরুদ্ধেই চলছে অভিযান। মালদ্বীপের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করছে। দিন যত যাচ্ছে ক্রমেই এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর অসাধু রিক্রুটিং এজেন্ট ও তাদের মনোনীত দালালদের প্ররোচনায় এসব কর্মীরা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বা কেউ কেউ বেশি টাকা দিয়ে মালদ্বীপ যাচ্ছেন। মালদ্বীপে নিয়ে এদের মধ্যে অনেককে সুনির্দিষ্টভাবে চাকরি দেয়া হচ্ছে না। মালে ভাষা না জানা অনেক কর্মী নিজেদের মতো করে চাকরি খুঁজে নিয়েছেন। মালদ্বীপের হোলেমাল, হাডডু ও হিমাবুসি আইল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালদ্বীপে অদক্ষ শ্রমিকরা মাসিক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১৫০ ইউএস ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় সর্বোচ্চ ১৩-১৫ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়েই তাদের থাকা ও খাওয়া সামলাতে হচ্ছে। বর্তমানে কনস্ট্রাকশন ফার্ম ছাড়া মালদ্বীপের কর্মসংস্থানের মান এখন সীমিত। ফলে কাজের ক্ষেত্র অনেক কমে এসেছে দেশটিতে। মালদ্বীপের হোলেমাল দ্বীপে কাজ করেন কুমিল্লার বুড়িচংয়ের জামাল মিয়া। তিনি জানান, চুক্তি অনুযায়ী দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় মালদ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে আসে এক শ্রেণীর দালালরা। এনেই হাডডু বা অন্য কোন দ্বীপে কাজ ছাড়া পাঠিয়ে দেন। এরপর বাধ্য হয়ে ভাষা না জানা বাংলাদেশীদের নিম্ন  বেতনে অবরুদ্ধ অবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ সময় বিভিন্নভাবে বাংলাদেশীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তারা ঠিকভাবে বেতন-ভাতা, বাসস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। মালদ্বীপে কর্মরত শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, হোলেমাল আইল্যান্ডের জেলখানায় বর্তমানে কয়েক শতাধিক বাংলাদেশী রয়েছেন। তাদেরকে বিভিন্ন হোটেল বা গেস্ট হাউজ থেকে কর্মরত অবস্থায় ধরে নিয়ে এসেছে। এরপর জেলখানায় পুরে রেখেছে। এ আইল্যান্ডের একটি থ্রি-স্টার হোটেলে কাজ করেন মুন্সীগঞ্জের কবির শেখ। তিনি জানান, বাঙালিদের গাদাগাদি করে থাকার চিত্র দেখে আসুন। আপনার নিজেরই চোখে পানি চলে আসবে। এক রুমে ২০ থেকে ২৫ জন থাকছেন। ফলে নানা রোগ শোকে তাদের আক্রমণ করেছে। অনেক শ্রমিকের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে। শ্রমিকরা জানালেন, কয়েক মাস আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল মালদ্বীপ সফর করে। ওই প্রতিনিধি দলটি বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেলে সময় কাটানোতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। অথচ শুনেছি তারা মালদ্বীপের শ্রম বাজার সম্পর্কে একটি মজাদার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকরা জানালেন, দূতাবাস কর্মকর্তাদের মন নেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেখভাল করতে। ভারতের একজন নাগরিক বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। শারীরিকভাবে মালদ্বীপের কোন নাগরিক আঘাত করলেও সুষ্ঠু বিচারের জন্য চাপ দেন। কিন্তু ভিন্নচিত্র বাংলাদেশের কোন নাগরিকের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের কোন শ্রমিক বিপদে পড়লে তাদের সহায়তার জন্য দূতাবাসের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর খোঁজ মেলে না। দূতাবাসের  শীর্ষ পদটি কয়েক মাস ধরে খালি থাকলেও এনিয়ে সরকারের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। মালদ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমিকদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে ওই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে হেড অফ হাই কমিশন পদে নিযুক্ত মো. অহিদুজ্জামান লিটনকে বার বার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। দূতাবাসের নম্বরে ফোন করা হলে বলা হয়, স্যার এখন অনেক ব্যস্ত। এই মুহূর্তে কোন কথা বলতে পারছেন না।

No comments

Powered by Blogger.