ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকেও নেই! by শুভংকর কর্মকার

সাভারের রানা প্লাজা ধসের দেড় বছর পূর্ণ হলো আজ শুক্রবার। এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের একটি অংশ এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ করে ক্ষতিপূরণ বুঝে পেয়েছেন। এই হারে বাকিদের পাওয়াটাও নিশ্চিত। আর ক্ষতিপূরণের পুরোটা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কারণ, বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে অর্থ দিচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বে গঠিত রানা প্লাজা সমন্বয় কমিটির প্রাথমিক হিসাবে বলা হয়েছিল, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য চার কোটি ডলার প্রয়োজন। তবে দাবিনামা পূরণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সমন্বয় কমিটির সদস্যরা বলছেন, সর্বোচ্চ তিন কোটি ৮০ লাখ ডলার হলেই হবে। অবশ্য কমিটির ‘ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড’–এ এখন পর্যন্ত জমা আছে এক কোটি ৯৪ লাখ ডলার। প্রয়োজন আর এক কোটি ৮৬ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ১৪৫ কোটি টাকার মতো দাঁড়ায় (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ধরে)।

>>রানা প্লাজা ধসের পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়ে। সেখান থেকে খরচ হয়েছে মাত্র ২২ কোটি।
শ্রমিকনেতা ও সমন্বয় কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, রানা প্লাজা ধসের পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকার মতো জমা পড়ে। সেখান থেকে চিকিৎসা, অনুদানসহ বিভিন্ন খাতে খরচ হয় প্রায় ২২ কোটি টাকা। বাকি টাকা ট্রাস্ট ফান্ডে দেওয়া হলে খুব সহজেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি মীমাংসা হতে পারে।
অবশ্য জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু গত বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রাস্ট ফান্ডের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি পুরোপুরি আইএলওর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে, তবে কমিটিতে সরকারের একজন প্রতিনিধি আছেন। প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল থেকে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্তকে অর্থ-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে আর কোনো সাহায্য করার কোনো পরিকল্পনা নেই।’
শ্রম প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, “রানা প্লাজা ফান্ড” নামে প্রধানমন্ত্রীর কোনো তহবিল নেই। সব অনুদান প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে জমা হয়। সেখান থেকেই যেকোনো দুর্যোগে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। ফলে রানা প্লাজা বাবদ ১০৫ কোটি টাকা থাকার বিষয়টি সঠিক নয়।’
গত বছরের ১৪ জুলাই জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানান, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা পড়েছে ১২৭ কোটি ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৯ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এ অর্থ দেন। এ কথা উল্লেখ করে জানতে চাইলে মুজিবুল হক বলেন, ‘উনি কী বলছেন, আমার জানা নেই।’
এ বিষয়ে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) যুগ্ম সমন্বয়কারী রাজেকুজ্জামান রতন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুঃজনকভাবে লক্ষ করলাম, এত মানুষের মৃত্যুও পোশাকশিল্পের মালিক ও রাষ্ট্রকে সচেতন করতে পারেনি। যদিও ক্ষতিপূরণ দিয়ে মানুষের জীবনের মূল্যায়ন হয় না। তবু দ্রুত কাজটি করা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বেঁচে থাকার অবলম্বন পেত। একই সঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হতো, শ্রম এত সস্তা নয়।’
এদিকে রানা প্লাজা ধসে হতাহত শ্রমিকদের এখনো যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেওয়াটা ‘লজ্জাজনক’ বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ সফর করা জার্মানির পার্লামেন্টের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল। গত সপ্তাহে ঢাকা ত্যাগের আগে প্রতিনিধিদলের সদস্য সাখা রাবে সরকারের সমালোচনা করে গণমাধ্যমকে বলেন, ভবনধসে যে ক্ষতি এসব মানুষের ভাগ্যে ঘটেছে, তার তুলনায় নগণ্য হলেও পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ সরকার এখনো দেয়নি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ না দেওয়াটা কারখানার মালিক, ক্রেতা ও সরকার—সবার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

>>ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ডে এখন পর্যন্ত জমা আছে এক কোটি ৯৪ লাখ ডলার। প্রয়োজন আরও এক কোটি ৮৬ লাখ ডলার
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও কয়েক শ শ্রমিক। এ ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অর্থ জমা দেন। অবশ্য মতিয়া চৌধুরী সংসদে অর্থ জমার ওই হিসাব দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে আর কখনোই কিছু বলা হয়নি। তবে গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হতাহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও অর্থ-সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, উদ্ধারকর্মীদের চিকিৎসা ও অর্থ-সহায়তায় ২২ কোটি ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা খরচ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের দেড় বছর পরও ক্ষতিপূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাওয়াটা দুঃখজনক। সরকারের কাছে গচ্ছিত অর্থ খরচে উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সামগ্রিক বিচারে সরকারের উচিত এ বিষয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া।
সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, সরকার যদি নিজে থেকে এগিয়ে না আসে, তবে হাইকোর্ট এ ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিতে পারেন। কারণ, এর আগে ক্ষতিপূরণ নিয়ে হাইকোর্ট থেকে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও সেটি মাঝপথে এসে থেমে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন করে নির্দেশনা আসতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্রাস্ট ফান্ড থেকে শিগগিরই তৃতীয় কিস্তিতে ৮৫৮ নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবারের সদস্য ও আহত শ্রমিক ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ পাচ্ছেন। এর মধ্যে আছেন নিহত ১৩১ ও নিখোঁজ ৩৪ শ্রমিকের পরিবার এবং আহত ৬৯৩ শ্রমিক। তাঁদের স্বজনেরা পাবেন মোট ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০ টাকা।
এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে দুই কিস্তিতে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন নিহত শ্রমিকদের পরিবারের এক হাজার ৫৫২ সদস্য ও আহত ৩৫ শ্রমিক। ট্রাস্ট ফান্ড থেকে তাঁদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। অবশ্য এই ৪০ শতাংশ অর্থ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া অর্থ কর্তন করে রাখা হয়েছে। সমন্বয় কমিটি ও ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের দেওয়া তথ্য অনুয়াযী, দুই হাজার ৮৪৯ জন আহত, নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিক পরিবারের পাঁচ হাজার ৯৯ জন সদস্য দাবিনামা (ক্লেইম ফরম) পূরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে নিখোঁজ শ্রমিক আছেন কমপক্ষে ১৪১ জন। তাঁদের সবার জন্য আলাদা ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দাবিনামা পূরণের কাজ শেষ হয়।

>>গত বছরের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও কয়েক শ শ্রমিক
এদিকে আইএলওর এদেশীয় পরিচালক শ্রীনিবাস রেড্ডি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ক্ষতিপূরণের তৃতীয় কিস্তি আগামী সপ্তাহে এবং চতুর্থ কিস্তি পরের মাসে দেওয়া হবে। আশা করছি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্রেতা পর্যাপ্ত অর্থ দেবেন।’ তিনি পুরো প্রক্রিয়াটি ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনার কথা জানান। জানতে চাইলে সমন্বয় কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন একটি সীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। এর উদ্দেশ্য, যাতে কেউ অনেক টাকা পেল আর কেউ কিছুই পেল না, এমনটি না হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের জন্য মোট কত অর্থ লাগবে, সেটি আমরা কমিটির কাছে জানতে চেয়েছি। এটি পেয়ে গেলে বোঝা যাবে আরও কত টাকা লাগবে। তখন সরকারকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে পারি যে টাকা দেওয়ার জন্য।’
রানা প্লাজা ধসের দেড় বছর
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও কয়েক শ শ্রমিক ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ডে এখন পর্যন্ত জমা আছে এক কোটি ৯৪ লাখ ডলার। প্রয়োজন আরও এক কোটি ৮৬ লাখ ডলার রানা প্লাজা ধসের পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়ে। সেখান থেকে খরচ হয়েছে মাত্র ২২ কোটি

No comments

Powered by Blogger.