সফল স্টেটসম্যান শেখ হাসিনা by এম. নজরুল ইসলাম

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সপ্তমবারের মতো বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে তাঁর সরকারের চার বছরপূর্তি হয়েছে।
গত চার বছর সরকার পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। বিশ্বের বড় বড় দেশের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ আগামীতে বিশ্বে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, এমন কথাও এখন উচ্চারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ বিষয়ে এই আগ্রহের কারণও বিগত চার বছরের ইতিবাচক দেশ পরিচালনা। মানব কল্যাণবোধ আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত শেখ হাসিনা নিজের সবটুকু সামর্থ্য ঢেলে দিয়ে শোষিত-নির্যাতিত জনতার কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন তিন দশকেরও অধিককাল। রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে অবস্থানকালে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন ৩৪ বছরেরও কম বয়সে। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সামরিক স্বৈরশাসক জে. জিয়াকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ ফেরার পথ বন্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সামরিকতন্ত্রের সকল প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে দলের সভানেত্রী পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর বাঙালীদের সীমাহীন আস্থা ছিল। তাঁর নৃশংস হত্যাকা-ের পর তারা হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল। রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অভ্যুদয় দলের নেতৃত্বশূন্যতা পূরণ করে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিলাষী ছিলেন না। জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকা-ের পর কা-ারিহীন দলের নিমজ্জমান অবস্থা এবং আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে জে. জিয়ার ক্যু ও হত্যার রাজনীতির মহাদুর্যোগ থেকে দল এবং দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর তাগিদে এগিয়ে এসে শেখ হাসিনা ইস্পাতদৃঢ় মনোভাবের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি এক জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখে গণতান্ত্রিক রাজনীতির হাল ধরে, দেশী-বিদেশী চক্রান্ত মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করেছেন। আশির দশকজুড়ে সামরিক কর্তাব্যক্তির একচ্ছত্র স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের এবং পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি কারচুপির নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধের লড়াইয়ে তিনি সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। বছরের পর বছর অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র হননের উদ্দেশে নিত্যনৈমিত্তিক প্রচারণা উপেক্ষা করে একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে দলকে তিনি আবার ক্ষমতায় এনেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক ও সাম্প্রদায়িক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা তাদের পাকিস্তানী প্রভুদের ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধ্বংস করে চলছিল। সেই অবস্থায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি, গণশিক্ষার সাফল্য, বিধবাভাতা ও বয়স্কভাতার প্রবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রশংসনীয় সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যাপরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন তিনি। দেশ ও জনগণের কল্যাণে এতসব করার পরও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী আন্তর্জাতিক চক্রের সহায়তায় বিএনপি-জামায়াত জোট ষড়যন্ত্র করে ২০০১ সালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আত্মীয়করণ, পরিবারতন্ত্র, দলীয়করণ, চল্লিশ হাজার সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে সাধারণ ক্ষমা প্রদান, সত্তর হাজার সন্ত্রাসীর মামলা প্রত্যাহার, জঙ্গী মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থান, বোমা হামলা, অপারেশন ক্লিনহার্ট ও ক্রসফায়ারের নামে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা, অতি জরুরী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষ হত্যা, সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ইতিহাস বিকৃতি এবং অপশাসনের ফলে বাংলাদেশ অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র-এর কলঙ্কিত ভাবমূর্তি ধারণ করেছিল।
পরবর্তিতে দু’বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাজনীতিকরণের জটিল পরিবেশে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এ নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দুর্যোগময় গত চার বছর সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করেছেন। তিনি স্বৈরাচার ও মৌলবাদকবলিত, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত গণতন্ত্র বিবর্জিত দেশকে প্রগতি ও গণতন্ত্রে উত্তরণে সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইতিহাসে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের সংগ্রাম ও সাধনা একটি উজ্জ্¡ল অধ্যায় হয়ে থাকবে। সব সরকারেরই সাফল্য ও ব্যর্থতা থাকে। বর্তমান সরকারেরও আছে। কিন্তু এই সরকারের সাফল্যের বৈশিষ্ট্য এই যে, ঘনদুর্যোগময় সময় পাড়ি দিয়ে এই সাফল্যগুলো সরকারকে অর্জন করতে হয়েছে। বর্তমানেও এই সরকার যে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করছে তা সবই অতীতের গণবিরোধী সরকারের কাছ থেকে পাওয়া। এগুলোর সুষ্ঠু সমাধান সময়সাপেক্ষ। মাঝে মাঝে সরকার কোন কোন সমস্যা সমাধানে ভুলত্রুটি করলেও তারা সেই ভুলত্রুটি সংশোধনে আগ্রহ দেখায়।
মাত্র চার বছরে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার শেষে সাজা হয়েছে। চিরকালের দুর্ভিক্ষের দেশ উদ্বৃত্ত কৃষির দেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিদ্যুত ও গ্যাস সমস্যা সমাধানে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। জঙ্গী সমস্যা ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। তথ্যপ্রযুক্তির তৃণমূলভিত্তিক সম্প্রসারণ একটি বড় সাফল্য। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এই সরকার চমৎকার ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করেছে। অর্থনৈতিক দুর্যোগে সারা পৃথিবী যখন টালমাটাল তখন বাংলাদেশ নিজেকে যে এখনও সঠিক পথে ধরে রাখতে পেরেছে, এটা সরকারের একটা বড় কৃতিত্ব। বিশ্ব শান্তি, পরিবেশ রক্ষা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার কাজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সাফল্য বিশ্বময় স্বীকৃত। সংবিধানকে সামরিক শাসনের আবর্জনা থেকে মুক্ত করা, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি শক্ত করা, সর্বোপরি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাহসী পদক্ষেপ নেয়া ইত্যাদি কাজ এই সরকারের এক বিরাট ইতিবাচক দিক। যদি শেখ হাসিনার সরকার আগামী মেয়াদেও ক্ষমতায় থাকতে পারে তাহলে বর্তমানের ভুলত্রুটিগুলো দূর করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে তারা সফল হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সরকারের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি আজ খুব দৃঢ় অবস্থানে আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি সূচক ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে- এ কথা তিনি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন। আমাদের ভাবতে ভাল লাগে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০১১ সালের অধিবেশনে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন মডেল’ উত্থাপন করেন। গত মাসে জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্যরাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব পাস করেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ উত্থাপিত ‘শান্তির সংস্কৃতি ‘প্রস্তাবটিও এবার পাস হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, চার বছরে রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে উন্নয়ন কর্মসূচীতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে পেরেছি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। চার বছরে প্রায় ৩৮২ কোটি ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে। বিগত সরকারের একই সময়ে এসেছিল ১৮৭ কোটি ডলার
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে বিরাট অর্জন বলে আখ্যায়িত করেছে। সংস্থাগুলো সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেছে। দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ দেশ। বাংলাদেশকে ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধি-ইঞ্জিন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার আইন, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা প্রদান আইন, মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৪১ হাজার অসহায় দরিদ্র মানুষকে সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মামলাজট কমাতে উচ্চ আদালতে ৭১ ও নিম্ন আদালতে ১২৫ বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। জনপ্রশাসনকে দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। নারীর অধিকার সুরক্ষায় পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন করা হয়েছে। এসবই বর্তমান সরকারের সাফল্য। আগামী দিনেও সাফল্যের ধারা ধরে রাখার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালীর।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সাহস, প্রজ্ঞা, মমত্ববোধ, ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও সব ধরনের প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কেবল বাংলাদেশে নয় বিশ্বে অতুলনীয়। শেখ হাসিনা দেশী-বিদেশী চক্রান্ত এবং বার বার তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে একত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে দেশের ও দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে টিকে আছেন। হয়ত আরও দীর্ঘকাল থাকবেন।
ইতিহাস বলে, বিশ্বের অনেক সফল ও সেরা রাজনীতিকও এত দীর্ঘ সময় একটা দেশের জনপ্রিয় নেতার আসনে থাকতে পারেননি। আজ বিশ্বের খ্যাতিমান শীর্ষনেতাদের নামের তালিকায় যুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। তিনি এখন আর একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি একজন সফল স্টেটসম্যান। মানুষের মনে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবেন তাঁর অতুলনীয় সাহস ও সাফল্যের ভেতর দিয়ে। আগামী দিনের ইতিহাস লিখে রাখবে তাঁর সাফল্যগাথা।

লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
nazrul@gmx.at

No comments

Powered by Blogger.