একুশ মানে মাথা নত না করা- আজ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

 ফাগুনের নাতিশীতোষ্ণ দুপুর। উর্ধমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায় উত্তাল ধ্বনি_ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। হাজারো টগবগে সাহসী বাঙালী যুবকের বজ্রকঠিন এই উত্তাল সেস্নাগান চারিদিকে।
মায়ের ভাষা রৰায় এমনই দুর্বার শপথ নিয়ে '৫২ সালে অকাতরে প্রাণপাত করার দিন আজ। রক্তের আখরে লেখা বাঙালী জাতির ইতিহাসে বেদনার পাশাপাশি চিরগৌরবদীপ্ত ও অহঙ্কারের মহিমান্বিত আজ অমর একুশে। থোকা থোকা আগুনের ফুলকি-সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউদ্দিনসহ নাম না জানা অগণন মৃতু্যঞ্জয়ী ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি। বাঙালী জাতির মননে অনন্য মহিমায় সমুজ্জ্বল আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও আজ। শোক বিহ্বলতা, বেদনা, আর আত্মত্যাগের অহঙ্কারে ভাস্বর সেই মহান শহীদ দিবস। ভোরের আকাশ বাতাস বিষণ্ন করে আজ অগণিত কণ্ঠে বেজে উঠবে_ "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...।"
৫৮ বছর আগের কথা। ১৯৫২ সালের এই দিনে যাঁরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, তাদের বিরম্নদ্ধে সাহসে জ্যোতির্মান বাঙালী মাথার প'রে অগি্নগোলক নিয়ে ধুলোধূসরিত পায়ে, ঘামে ভেজা চুলে, অনল ঝরা চোখে, লালচে মুখে বাংলাদেশের সব শহরের রাসত্মায় রাসত্মায় মুষ্টিবদ্ধ হাতে রম্নখে দাঁড়িয়েছিল এক অলৌকিক প্রত্যয়ে। মায়ের মুখের ভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার দুর্মর দামাল ছেলেরা বুকের তপ্ত শোণিতে রঞ্জিত করেছিল রাজপথ। এক একটি বাংলা অৰর সেদিন পরিণত হয়েছিল বাঙালীর এক একটি জীবনে। বীর বাঙালী শহীদ ভাইদের সেই আত্মবলিদান আজ ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের সীমানা ছাড়িয়ে পেঁৗছে গেছে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে। বিশ্বে একমাত্র বাঙালীরই রয়েছে ভাষার জন্য জীবন বলিদান দেয়ার নজির। তাই এই দিনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সারা বিশ্ব আজ পালন করবে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
আজ শুধু বেদনার দিন নয়_ সাহসে, প্রেরণায়, প্রত্যয়ে, উদ্দীপনায়, সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার দিন। অাঁধার সরিয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হবার দিন। অশুভ, অন্ধকার প্রতিহত করার প্রত্যয়ে জাতি উদ্দীপিত হবে আজকের এই পবিত্র ৰণে। শোক, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অর্জনের এক অপূর্ব সম্মিলনে জাতি পালন করবে এই দিনটি। সকলের সব পথ আজ এসে মিশে যাবে শহীদ মিনারে। বাহারি ডিজাইনের সাদা কালো রঙের শোকের পোশাক পরে আজ শিশু, বুড়ো, তরম্নণ-তরম্নণী সবাই নেমে আসবে রাজপথে। অনেকের হাতে-কপালে থাকবে জাতীয় পতাকা, চিবুকে_কপোলে থাকবে শক্তি ও অহঙ্কারের প্রতীক শহীদ মিনার আর জাতীয় পতাকার মোটিফ।
মহান শহীদ দিবস শুধু আমাদের অর্জনেরই দিন নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সনত্মান হারানোর বেদনারও দিন। তাই শুধু আনন্দে মেতে থাকলেই আমাদের চলবে না, তাঁদের সেই ত্যাগ থেকে শিৰা নিয়ে ও শক্তি অর্জন করে বর্তমানের অশুভ শক্তির বিরম্নদ্ধে লড়তে হবে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি জঙ্গীবাদের বিরম্নদ্ধে লড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাসত্মবায়নে সরকারকে চাপে রাখতে হবে।
অমর একুশে উপলৰে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও তার আশপাশের এলাকায় রেড এ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো এলাকায় বসানো হয়েছে হাই ভোল্টেজ গোপন মুভি ক্যামেরা। প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক র্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সাদা পোশাকের সদস্যরা সর্বৰণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তার সর্বশেষ প্রস্তুতি দেখতে শনিবার র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
শুধু রাজধানীতেই নয়, আজ সারাদেশের মানুষ অাঁধার চিরে দিনের আলো ফোঁটার আগেই নগ্নপদে রাশি রাশি ফুলের মালা ও সত্মবক নিয়ে মন্থর পদৰেপে এগিয়ে যাবেন নিজ নিজ এলাকার শহীদ মিনার অভিমুখে। বসনত্ম শাখায় শাখায় ফুটিয়েছে যে অজস্র ফুল, প্রকৃতির সেই অর্ঘ্য আজ বাঙালীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে নিবেদিত হবে শহীদদের প্রতি। আত্মউৎসর্গকারীদের জন্য হৃদয় মথিত করা শোকের প্রতীকরূপে কালো পতাকা উড়বে প্রভাতফেরীতে।
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালী জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষণের সূচনা পর্ব। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালী জাতি। হাজার বছরের পরাধীনতার নিগড় ছিন্ন করে অর্জন করে স্বাধীনতা। তাই একুশে আজ বাঙালীর চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ধর্মান্ধতা, কূপম-ূকতা, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, অকল্যাণের বিরম্নদ্ধে কল্যাণ ও সংগ্রামের প্রেরণার উৎস।
একুশ মানে মাথা নত না করা। এ সত্য যেমন বাঙালীর জীবনে, তেমনি আজ তা পরিণত হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছেও সকল অন্যায় ও অবিচারের প্রেরণা হিসাবে। বাঙালীর ধমনীছেঁড়া রক্তেস্নাত একুশ আজ বিশ্বসভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববাসী আজ আমাদের প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, সংগ্রামের দিনটিকে তাঁদের মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করছেন আমাদেরই সঙ্গে। এই অনুভূতি, উপলব্ধি একুশের প্রতি বাঙালীর আবেগকে করেছে আরও প্রসারিত, শ্রদ্ধা ও প্রীতিকে করেছে গভীরতর।
বরাবরের মতোই শনিবার রাত বারোটা এক মিনিটে দিবসের সূচনা থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেমে আসে গণমানুষের ঢল। প্রথমেই রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধা জানান। তারপর বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান। শহীদ মিনারে পুস্পসত্মবকের পর জনতার ঢল নামে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের সমাধি জিয়ারত ও শ্রদ্ধা নিবেদনে।
আজ সরকারী ছুটির দিন। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। মহান শহীদ দিবস উপলৰে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পালন করছে বিশেষ কর্মসূচী। এর মধ্যে রয়েছে প্রভাতফেরী করে শহীদ মিনার ও শহীদদের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান তাঁর বাণীতে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের বাঙালী জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায় এবং স্বাধীকার অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। এ আন্দোলন তাই কেবলই আমাদের মাতৃভাষার দাবি আদায় করেনি; বরং এরই পথ বেয়ে ১৯৭১ সাল অর্জিত হয় বাঙালী জাতির বহু কাঙ্ৰিত স্বাধীনতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, ৫২'র ভাষা আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত অর্জন এখন আর শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউনেস্কো এদিনটিকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ায় মহান একুশে আজ সারা বিশ্ববাসীর।
বিসত্মারিত কর্মসূচী : অমর একুশে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলৰে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। জীবিত ভাষা সৈনিকরা আজ বিকাল ৩টায় ঐতিহাসিক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আমতলা থেকে মিছিল বের করবেন। কিংবদনত্মিতুল্য এসব ভাষা সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দেবেন নতুন প্রজন্মের প্রত্যয়ীরাও। মাতৃভাষা দিবস উপলৰে দু'দিনব্যাপী কর্মসূচী পালন করছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। আলোচনা সভার পর আজকের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে_ প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি, সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো ব্যাজ ধারণ, সকালে প্রভাতফেরীসহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরে ও শহীদ মিনারে পুষ্পসত্মবক অর্পণ।
বিএনপির দু'দিনের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, প্রথম প্রহরে এবং ভোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পসত্মবক অর্পণ, সারাদেশে দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিবসটি উপলৰে জাসদ (রব) শনিবার আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সংগঠনটির সভাপতি সভায় একুশের স্বপ্ন বাসত্মবায়নে স্বাধীন দেশের উপযোগী রাষ্ট্র প্রশাসন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে শনিবার আলোচনা সভার আয়োজন করে সার্ক কালচারাল সোসাইটি। সভায় স্পীকার এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ বাংলা ভাষাকে সর্বসত্মরে ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ৰুদ্র জাতিসত্তার ভাষাকেও সমান মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান।
দিবসটি উপলৰে ভিন্নধর্মী বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘ। সংগঠনটি বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের জাতীয় পতাকা ত্রিশটি দেশের ভাষার বর্ণমালা সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রা নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
একুশের নানা কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। কমসূচীর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সব পার্টি কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং আজিমপুর কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন।
আজ সকাল ৬টায় পলাশী মোড়ে জমায়েত হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরৰণ পরিষদ। আজ সকাল দশটায় নজরম্নল মিলনায়তনে আলোচনা সভা, ছড়া পাঠের আসর ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র। সকাল সাড়ে দশটায় বায়তুল মোকাররমে ভাষা শহীদদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত, দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো পতাকা উত্তোলন এবং ২৪ ফেব্রম্নয়ারি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
দিবসটি উদযাপন উপলৰে তিনদিনব্যাপী কর্মসূচী পালন করছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। কর্মসূচীর দ্বিতীয় দিন শনিবার শিশু কিশোর পরিবেশনায় সিলভারডেল সংগীত একাডেমী ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী। আজ রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্মৃতিসৌধ মাঠে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সংগঠনটি।

No comments

Powered by Blogger.