২০১৩ ॥ বহুবিধ সত্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জের বছর- মাসুদা ভাট্টি

২০১৩ সাল যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই এই বছরটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বাড়ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের পর দেশে-বিদেশে এই ভাষণ নিয়ে মানুষ কথা বলতে শুরু করেছে।
জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতা হিসেবে এই ভাষণ খুব নতুন কিছু নয়; কিন্তু অনেকেই এই ভাষণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমিও মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অন্ততপক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা যাই-ই বলবেন, তাই-ই গুরুত্বসহকারে মানুষ শুনবে। কারণ ২০১৩ কোন মামুলি বছর নয়, এই বছর অন্য যে কোন বছরের তুলনায় নতুনভাবে দেখার দাবি রাখে। যেমনটি ২০১১ বা ২০১২ ছিল, কোন দিক দিয়েই ২০১২ তেমন নয়, তবে ২০০১ কিংবা ২০০৮-এর সঙ্গে ২০১৩ সালের বেশ ভাল মিল খুঁজে পাই আমি। এই মিল কারণ, বছরটি নির্বাচনের বছর। যে কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশেই নির্বাচনের বছরটি অত্যন্ত সতর্ক ও আঘাত পাল্টাআঘাতের বছর; এই আঘাত রাজনৈতিক, এই পাল্টা আঘাতও রাজনৈতিক, এদের নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই।
আমরা যদি বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতার দিকে চোখ রাখি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। না, এই চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক নয়, এই চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখতে গেলে, সত্যিই রাজনৈতিক কি? কারণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটি দল জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবে এবং ৫ বছর পর মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন দিয়ে জয়ী হলে ক্ষমতায় ফিরবে, না হলে পরাজিত হয়ে বিরোধী দলের আসনে বসবে। খুব স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়া। কিন্তু কোন এক দুর্জ্ঞেয় কারণে আমরা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছি। আমরা প্রথমে সামরিক শাসনের কবলে পড়লাম, যে সামরিক শাসন থেকে বেরুনোর জন্য আমরা যে কোন শর্তেই রাজি হয়ে যাই। তখনকার বাস্তবতায় এই শর্ত মেনে নেয়াটা জরুরীও ছিল বটে। কিন্তু তারপর ক্রমশ এই প্রশ্ন দৃঢ় হতে থাকে যে, যে দলটিকে জনগণ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করে দেশ ও জাতির পুরো দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিতে পারে কেবলমাত্র নির্র্বাচন অনুষ্ঠানকালে দলটিকে মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না- এটা কি মেনে নেয়ার মতো কথা? রাজনৈতিক দলগুলো এই যে এ রকম সময়ে এসে বিশ্বাস, আস্থা ইত্যাদি শব্দের সঙ্কটে ভুগতে শুরু করে, একেই বোধ করি বিজ্ঞজনরা বলবেন, গণতন্ত্রের সঙ্কট কিংবা ভাল গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্বলতা। সে যাই-ই হোক, বাংলাদেশ ২০১৩ সালে এসে আবার সেই দুর্বলতায় ভুগতে শুরু করেছে। যদিও কোন কারণ নেই এর, ইতোমধ্যেই দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। কিন্তু আমাদের বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলো এই সত্য মেনে নিতে নারাজ, তারা সেই বস্তাপচা তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে যে টানাপোড়েন তৈরি করছে তাতে দেশ কোন নতুন খন্দে পড়ে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা দিনকে দিন ঘনীভূত হচ্ছে। ২০১৩ সাল নিজেই তাই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেখা যাক এই চ্যালেঞ্জে কে জয়ী হয়!
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের রয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূল সময় পেরুনোর অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে হয়ত এবারও আওয়ামী লীগ পার করে দেবে ২০১৩ সালকে। কিন্তু একথা দলটিকে মাথায় রাখতে হবে যে, ২০১৩ সাল আসলে খুব হেলা-ফেলায় পার করার মতো বছর নয়। বছরটি জনগণের সিদ্ধান্তের বছর। সুতরাং এই বছরকে ঘিরে যদি পরিকল্পনামাফিক দলটি এগুতে না পারে তবে এর মূল্য কেবল আওয়ামী লীগকে নয়, দিতে হবে গোটা জাতিকে। সেটা কেমন? ২০০৮ সালের নির্বাচনে যাঁরাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারটি দেখেছেন তাঁরাই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, দলটি নির্র্বাচনের আগেই দেশের মানুষের কাছে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান। এটি একটি মৌলিক বিষয় সন্দেহ নেই, কারণ বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে এই জঞ্জালরা বড় ধরনের বাধা তৈরি করে আছে। ফলে এই বাধা সরানোটাও জরুরী। একটু সময় ক্ষেপণ করে হলেও এই প্রক্রিয়া শুরু করেই এটি একটি মৌলিক বিষয় সন্দেহ নেই, কারণ বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে এই জঞ্জালরা বড় ধরনের বাধা তৈরি করে আছে। ফলে এই বাধা সরানোটাও জরুরী। একটু সময় ক্ষেপণ করে হলেও এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বিচারের পথটি কোনভাবেই স্বাভাবিক ছিল না, থাকার কথা নয়। এর পক্ষে যেমন তুমুল জনমত ও জনসমর্থন রয়েছে, তেমনই এর বিপক্ষেও রয়েছে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী। এরা সংখ্যায় বেশি নয় যদিও কিন্তু অর্থ কিংবা ষড়যন্ত্রের শক্তিমত্তায় এরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে যে কোন সময়ই এক হাত নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হবে কি না তা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি কিংবা আশা করতে পারি যে, অপশক্তি সবসময়ই পরাজিত হয়, কিন্তু সেই সেই সত্য এখন একটু নড়বড়ে ঠেকছে। কারণ আমরা দেখছি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের রক্ষায় তারা কেমন আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে। কেমন করে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের মিছিল পরিণত হচ্ছে সহিংস ও জঙ্গী তৎপরতায়। এখানেই ২০১৩ এমন গুরুত্বপূর্ণ এক বছর যে বছরে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোনো কিছু মোকাবিলার জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অপশক্তি হয়ত এখন এমন এক ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেবে যা বাংলাদেশ ভাবতেও পারেনি। আর সেটি হয়ত হবে এমনই নৃশংস যে, সাধারণ মানুষ তা হয়ত কল্পনায়ও আনতে পারবে না। আর এখানেই আওয়ামী লীগ সরকারের সতর্ক থাকার বিষয়টি সবচেয়ে জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ এই অপশক্তির টার্গেট কেবল আওয়ামী লীগ নয়, আওয়ামী লীগকে যারা ভোট দিয়ে দেশ শাসনের সুযোগ দিয়েছে, সেই সাধারণ জনগণও।
দ্বিতীয় একটি বিষয় আওয়ামী লীগের মাথায় রাখাটা জরুরী বলে আমার মনে হয়েছে। সেটি হলো, যে কোন মূল্যে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। বাংলাদেশে নতুন কোন শাসনব্যবস্থা জারি হলে তার ক্ষতি বাংলাদেশ আর পুষিয়ে উঠতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি, যে কোন সূচকেই বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্র্জন করেছে। এই এগিয়ে যাওয়া সূচক থেকে বাংলাদেশ যদি একটুখানিও পেছায় তাহলে এর চড়া মূল্য দিতে হবে জনগণকে। এর আগের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষ যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবার এমন কিছু হলে তার ক্ষতির পরিমাণ অতীতের যে কোন রেকর্ড অতিক্রম করবে। এটা এ কারণে বলা যে, অগ্রগতির যে ধারাবাহিকতা তা যদি কোনভাবে ব্যাহত হয় তাহলে তা নেতিবাচক সূচকের দিকে দ্রুত এগুতে থাকে। তাকে ফিরিয়ে এনে আবার স্বাভাবিক করার মধ্যবর্তী যে সময়, সে সময়ে দেশ পিছিয়ে যায় অনেকখানি। এখানে আমরা থাইল্যান্ডের উদাহরণ টানতে পারি। দেশটির স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া ও বিগত নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে যে টানাপোড়েন দেখা গেছে তাতে দেশটি প্রায় ২-৩% প্রবৃদ্ধি হারিয়েছে, যাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ আখ্যা দিয়েছেন ‘গণতন্ত্রের ক্ষত’ (উন্ড অব ডিমেক্র্যাসি) হিসেবে। বাংলাদেশে এই ক্ষত নতুন করে তৈরি হোক, তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারোরই কাম্য হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। সাধারণ জনগণ তো চাইবেই না। আর আওয়ামী লীগ যদি সে রকমটি না চায় তাহলে সবার আগে আওয়ামী লীগকে তার সংসার অর্থাৎ দলকে গোছাতে হবে সুচারুভাবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আমরা এমন কোন পদক্ষেপ দেখিনি যাতে বোঝা যেতে পারে যে, দলের ভেতরকার ক্ষোভ বা অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বরং, বাইরে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে যে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বেশ নাজুক অবস্থানে এসেই দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালের মতো গুরুত্বপূর্ণ বছরে আওয়ামী লীগের যে কোন নাজুকতা যে কত বড় সর্বনাশের হতে পারে, তা রাজনীতি নিয়ে সামান্য ভাবেন যাঁরা তাঁরাও বুঝতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখাটি দীর্ঘায়িত করার যথেষ্ট ও সঙ্গত কারণ আছে কিন্তু তাতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। তাই শেষ করছি বিএনপির কথা দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে অস্বীকার করার উপায় নেই, বরং বিএনপি চাইলে যে দেশকে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চাইলে যে কোন জাতীয় ইস্যুতেই ঐকমত্য পোষণ করে দেশটাকে রাতারাতি বদলে দিতে পারে বলে আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু তা যেন হবার নয়, বা তা হতে দিতে চায় না বহুবিধ পক্ষ। এই বহুবিধ পক্ষরা দু’দলের ভেতরই সক্রিয় বলে প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিষয়ও মীমাংসার ক্ষেত্রে বিএনপির ঐকমত্যে না পৌঁছাটা দুঃখজনক। আজকে জামায়াতের সঙ্গে মিলে বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়ানোটা ২০১৩ সালে বিএনপির সবচেয়ে বড় ভুল বলে বিচার করবে অনাগত কাল, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এতে দলটি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনই এর বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীও পড়বে জনরোষের মুখে। আর সে রকমটি বুঝতে পারলে দলটি যদি নির্বাচন বর্জন কিংবা নির্বাচন থেকে দূরে থাকে তাহলে সেটাও হবে এক আত্মঘাতী ভুল। যে ভুলের মাসুল কেবল বিএনপিকে নয়, দিতে হবে গোটা দেশকে। এটাই বোধ করি, বিএনপির জন্য ২০১৩ সালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জও, দলটি এই বছরকে কিভাবে মোকাবিলা করে, তার ওপরই নির্ভর করছে দলটির ভবিষ্যত রাজনীতিও। এখানে ছোট্ট করে বলে রাখি যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাঙালী জাতি প্রস্তুত কিন্তু এই প্রস্তুতিকে যে দলই বুঝতে ভুল করবে কিংবা ভুলভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেবে, তারাই জনগণের মন থেকে নিক্ষিপ্ত হবে অতলে- সত্য আজ এখানে দাঁড়িয়ে।

ঢাকা, ১৩ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১৩।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ।
masuda.bhatti@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.