সাড়ে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাসের রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে -গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি by অরুণ কর্মকার

সরকার বন্ধ ঘোষণা করলেও গোপনে এবং নানা কৌশলে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া-নেওয়া চলছেই। অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এসব সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকেরা বলছেন, গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে সরকারই দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে।


সরকারি হিসাবে শুধু আবাসিক খাতে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ কোটি (৫৫ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে। সরকার নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করার পর প্রায় দুই বছরে আবাসিক খাতে এই সাড়ে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ব্যবহার ও সরবরাহ বেড়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় দুই বছর আগে গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষণার সময় আবাসিক খাতে মোট গ্যাসের ব্যবহার ছিল প্রতিদিন সাড়ে ২১ কোটি (২১৫ মিলিয়ন) ঘনফুট। আর আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে হিসাব করে দেখা গেছে, আবাসিক খাতে এখন প্রতিদিন ব্যবহূত হচ্ছে ২৭ কোটি (২৭০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস।
সরকার ২০০৯ সালের ২১ জুলাই শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর এখন পর্যন্ত আবাসিক খাতে ব্যয়সাশ্রয়ী বিকল্প কোনো জ্বালানি সহজলভ্য না হওয়ায় এবং অর্থের বিনিময়ে গোপনে ও কৌশলে সংযোগ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রাহকেরা এই পথে গেছেন।
গ্রাহক ও সরকারি সূত্রগুলো জানায়, সরকার অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অসংখ্য গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি জানে। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এ থেকে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু বৈধ পথে নতুন সংযোগ বন্ধ করে রেখে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো জানায়, আবাসিক খাতের এই সাড়ে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাসের রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। গ্যাস বিতরণ ও বিপণন কোম্পানিগুলোর একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী নতুন সংযোগ দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই ওই সব সংযোগের মাসিক বিলও আদায় করে নিচ্ছেন।
তিতাস, বাখরাবাদ ও কর্ণফুলী—এ তিন কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকাতেই অবৈধভাবে কৌশলে নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার কর্মকাণ্ড চলছে।
প্রতি ফ্ল্যাটে ৩০ হাজার: ঢাকায় এখন প্রতিটি ফ্ল্যাটে নতুন গ্যাস-সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আবাসন কোম্পানিগুলোও ফ্ল্যাট মালিকদের কাছ থেকে এই টাকা নিয়ে নতুন গ্যাস-সংযোগের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আবাসন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনেও ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগের নিশ্চয়তা’ দেওয়া হচ্ছে।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট মালিকেরা বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দালাল ধরে টাকার বিনিময়ে সংযোগ নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, টাকার অঙ্ক ক্ষেত্রবিশেষে কম-বেশি হয়। যেমন, যে ভবনে ১০টি ফ্ল্যাট, সেখানে প্রতি ফ্ল্যাটে সংযোগের জন্য ৩০ হাজার টাকাই দিতে হয়। কিন্তু যে ভবনে ১৬টি ফ্ল্যাট, সেখানে ফ্ল্যাটপ্রতি ২৫ হাজার টাকায়ও সংযোগ মেলে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটপ্রতি ৪০ হাজার টাকাও লাগে।
ফ্ল্যাটবাড়ি ছাড়াও একতলা, দোতলা বাড়ি, টিনশেড ঘর এমনকি বস্তিতেও গোপনে ও কৌশলে নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া থেমে নেই। সংযোগ পাচ্ছেন না শুধু তাঁরা, যাঁরা বৈধভাবে সংযোগ নেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে দেওয়া চাহিদাপত্র (ডিমান্ড নোট) নিয়ে বসে আছেন। আর পাচ্ছেন না তাঁরা, যাঁরা কোনোভাবেই অবৈধ পন্থা অনুসরণ করতে চান না।
সরেজমিন বনানী: বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি ও কড়াইল বস্তিতে প্রায় নয় হাজার পরিবার অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস ব্যবহার করছে। তবে সেখানে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। কারণ, একেকটি সংযোগ একাধিক পরিবার ব্যবহার করে। এর অধিকাংশই নেওয়া হয়েছে নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষণার পর।
কলোনির টিনশেড ঘরগুলোর কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সংযোগ নেওয়ার সময় এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এরপর প্রতি মাসে এক চুলার জন্য ৫০০ টাকা করে দিচ্ছেন। সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং প্রতি মাসে বিল তোলার জন্য ওই এলাকায় নির্দিষ্ট কয়েকজন লোক আছেন।
কড়াইল বস্তিতে অবৈধভাবে সংযোগ নিয়ে গ্যাস ব্যবহারকারীদের কয়েকজন বলেন, তাঁদের দুই থেকে চারটি পরিবার একেকটি চুলা ব্যবহার করে। সংযোগ নেওয়ার সময় প্রত্যেক পরিবার এক হাজার টাকা করে দিয়েছে। এখন প্রতি মাসে একটি চুলা ব্যবহারকারীরা মিলে এক হাজার টাকা করে দিচ্ছেন।
হিসাবের মারপ্যাঁচ: তিন বছর ধরে শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের এবং দুই বছর ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা হলেও এ সময় দেশে গ্যাসের চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। একমাত্র তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতাধীন এলাকাতেই চাহিদা বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট।
বাখরাবাদ ও কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির এলাকাতেও চাহিদা বেড়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের সূত্র জানায়। অবশ্য প্রতিটি বিতরণ কোম্পানির এলাকাতেই কয়েকটি করে শিল্পে বিশেষ বিবেচনায় সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব সংযোগের ফলে যেটুকু গ্যাস বেশি ব্যবহার হওয়ার কথা, মোট চাহিদা বৃদ্ধির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু হিসাবের মারপ্যাঁচে ওই পরিমাণ আড়াল করে রাখা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, দেশে আবাসিক খাতে গ্যাসের ব্যবহার মোট সরবরাহের ১২ শতাংশ। ২০০৯ সালে যখন দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১৭৫ কোটি ঘনফুট, তখনো এই ব্যবহার ১২ শতাংশ (২১ কোটি ঘনফুট) ছিল। এখন গ্যাসের উৎপাদন বেড়ে ২২৫ কোটি ঘনফুট হওয়ার পরও তা ১২ শতাংশ (প্রায় ২৭ কোটি ঘনফুট)। এই চাহিদা বেড়েছে বিশেষ কৌশলে অসংখ্য সংযোগ দেওয়ার ফলে। কিন্তু শতাংশের হিসাবের আড়ালে বিতরণকারী সংস্থাগুলো পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.