বগুড়ার ‘অতিথি সাংসদ’ এলাকায় যান না by আনোয়ার পারভেজ

বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সাংসদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ দীর্ঘদিন নির্বাচনী এলাকায় যান না। স্থানীয় বিএনপিতে ‘অতিথি সাংসদ’ হিসেবে পরিচিত এই নেতা সর্বশেষ এলাকায় গিয়েছিলেন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে।


সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মভিটা গাবতলী উপজেলা বিএনপির নেতাদের দাবি, মওদুদ স্বেচ্ছায় এলাকায় আসেন না, এটা ঠিক নয়। মূলত স্থানীয় বিএনপিই তাঁকে এলাকায় আসতে দিতে চায় না। কারণ, তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ইতিমধ্যে তাঁকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।
জানতে চাইলে মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রতি মাসে নিয়মিত এলাকায় যেতেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিএনপিতে সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এখন আর তাঁর পক্ষে ঠিকমতো এলাকায় যাওয়া হয়ে ওঠে না।
এলাকার দলীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে মওদুদ বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় বিএনপিতে প্রচণ্ড কোন্দল, নেতা-কর্মীরা বিভক্ত। দলীয় চেয়ারপারসন অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এখানে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তাই আমার জন্য দলে কোনো বিশৃঙ্খলা বা সমস্যা হোক, সেটা আমি চাই না। মূলত বিশৃঙ্খলা এড়াতেই আপাতত এলাকায় যাচ্ছি না।’ এলাকায় যেতে না পারার কারণে তিনি টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচির প্রকল্প তালিকা তৈরি করেন ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের দিয়ে। তিনি জানান, ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএস) দিয়ে তিনি কখনোই তালিকা তৈরির কাজ করেন না।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে সাংসদ নির্বাচিত হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিয়ে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেন মওদুদ আহমদকে। ‘অতিথি প্রার্থী’ হলেও ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের সুবাদে বিপুল ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ সালে ২ এপ্রিল উপনির্বাচনে জেতার পর কিছুদিন এলাকায় গিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে অংশও নেন, এরপর আর যান না।
এলাকায় যেতে না পারায় মওদুদ আহমদ এরই মধ্যে সৈয়দ আহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, গাবতলী মহিলা কলেজ ও বাগবাড়ী শহীদ জিয়া মহাবিদ্যালয়ের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।
মওদুদ আহমদের নিজের নির্বাচনী এলাকা হচ্ছে নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরগঞ্জ)। গত নির্বাচনে এই আসনে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে হেরে যান।
গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি মনে করে, এটি জিয়া পরিবারের আসন। জিয়া পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই মওদুদ আহমদকে আসনটি উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্তকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছিল এলাকাবাসী। কিন্তু সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি হয়ে গেলেন অতিথি পাখি। হাতেগোনা কয়েকবার এলেও দেড়-দুই বছর ধরে এলাকায় পা মাড়াননি।’
আমিনুল ইসলাম জানান, মওদুদ এলাকায় না এসে তাঁর পিএস মোমিনুর রহমান ও এপিএস আবদুল হান্নানকে দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। পিএস-এপিএস আর আস্থাভাজন নেতা ও গাবতলী উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিয়ে টিআর-কাবিখা প্রকল্পের তালিকা তৈরি করছেন। এ কাজ করতে গিয়ে সাংসদের নাম ভাঙিয়ে পিএস-এপিএস ও পছন্দের নেতারা প্রকল্প থেকে ইচ্ছামতো কমিশন আদায় করছেন। সরকারি বরাদ্দ থেকে কমিশন হাতিয়ে নিয়ে সাংসদের আস্থাভাজন একজন নেতা এখন রাতারাতি কোটিপতি। সাংসদ হওয়ার আগে তিনি কথা দিয়েছিলেন, দলের নির্যাতিত নেতাদের রাজনৈতিক মামলাগুলোয় তিনি বিনা পয়সায় লড়বেন। এখন মোটা টাকা ছাড়া তিনি কোনো মামলা হাতে নেন না।
সাংসদের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত গাবতলী উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদ হওয়ার পর মওদুদ আহমদ সাত-আটবার এলাকায় এসেছেন। তবে বেশ কিছুদিন হলো তিনি আসছেন না। তাঁর অবর্তমানে যাঁকে তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁকেই উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেন। এলাকার মানুষ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাঁর অজান্তে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা টিআর-কাবিখার মতো প্রকল্পে কমিশন-বাণিজ্য করছেন। তবে “কমিশন-বাণিজ্য” বা অর্থ হাতানোর কোনো ঘটনায় তিনি সম্পৃক্ত নন বলে জানান।
সাংসদের পিএস মোমিনুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দ আসে গড়ে দুই-তিন শ মেট্রিক টন চাল-গম। অথচ প্রকল্পের জন্য আবেদন আসে দেড় থেকে দুই হাজার। যাঁরা প্রকল্প চেয়ে পান না, তাঁরা কমিশন-বাণিজের অভিযোগ তোলেন। কাজ করতে গেলে এসব অভিযোগ আসবেই।
‘ধানের শীষত ভোট দিচি, এমপিক চোখে দেখিনি’: সম্প্রতি সরেজমিনে গাবতলী ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ধানের শীষ দেখে তাঁরা ভোট দিয়েছেন। মওদুদ আহমদকে তাঁরা চিনতেন না। সাংসদ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনি ভোটারদের কাছে ‘অচেনা মানুষ’।
গাবতলী পৌর এলাকার হাসনাপাড়ার কৃষক লালমিয়া ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘ধানের শীষত ভোট দিচি, এমপিক হামরা কোনো দিন চোখে দেখিনি।’ জাকির হোসেন রসিকতা করে বলেন, ‘হামাগেরে এমপির নাম মওদুদ, ভোট দেওয়ার পর তিনি হামাগরক খালি খাওয়াচ্চে আম-দুদ।’ কৃষক রতন আকন্দ বলেন, ‘এলাকাত এমপি আসপি ক্যামন করে, বিএনপি কলাগাছ দাঁড়ে দিলেও হামরায় তাকে জিতে দেই। বিদেশিক ভোট দিয়ে একন ঠেলা সামলাচ্চি।’
‘চেরাগ দিয়ে খুঁজেও পাই না’: গাবতলীর হাতীবান্ধা গ্রামের রিকশাচালক দুলু মিয়া বলেন, ‘হামরায় বিএনপিক ভোট দিচি। এমপির জানার হামাগেরে দরকার কী? তবে শুনেচি, হামাগেরে এমপির নাম মওজুত আহম্মদ’। গাবতলীর নাডুয়ামালা ইউনিয়নের হাপানিয়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী আজিজার রহমান বলেন, ‘হামাগেরে এমপির নাম মাহবুবুর রহমান।’ সন্ধ্যাবাড়ি গ্রামের জোবেদা বেওয়া বলেন, ‘হামাগেরে এমপির নাম মওদুপ আহমদ। তাক চেরাগ দিয়ে খুঁজেও পাই না’। আলেফা বেগম বলেন, ‘জিয়ার বাড়ি এটি, তাই ধানের শীষত ভোট দিচি, একন না খ্যায়া থাকলেও “মঈদুল এমপি” হামাগেরে কোনো খোঁজখবর লেয় না।’
বগুড়া-৭ আসনের সাবেক সাংসদ এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক হেলালুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দায়িত্বশীল নেতা হওয়ার পরও মওদুদ সাহেব লাগামহীন ও উল্টাপাল্টা বক্তব্য দেন। এ কারণেই বগুড়ায় তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এ কারণে আমরা ভয়ে তাঁকে এলাকায় আসতে দিতে চাই না। এলাকায় এসে তিনি কী বলতে কী বলে ফেলেন, এই ভয়ে তৃণমূলের বিএনপি তাঁকে এলাকায় আসতে দিতে চায় না।’

No comments

Powered by Blogger.